- সুনামগঞ্জ বার্তা - http://sunamganjbarta.com -

আঁধার ঘিরেছে তাকে…

আমিনুল ইসলাম রোকন:: রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর। অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় ধরে তিলে তিলে গড়েছেন বর্ণ্যাঢ্য ক্যারিয়ার। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা হয়েছেন সিলেটের প্রিয় নাম। সিলেটৈর শেষ পৌর চেয়ারম্যান আবার প্রথম সিটি মেয়র দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন অনন্য রেকর্ড কেবল তার ই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সিএলএটর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনও সেই নামটি-বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। সিলেটের রাজনিতির আকাশে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে নামটি যেন এখন নিখাদ কালো আঁধারে ঢাকা পড়েছে।  কামরানের প্রত্যাশার হাত ফিরেছে অন্তিম শূণ্যতাকে ছুয়ে। সেই ২০১৩ সালের ১৫ জুন কামরান নামটি ঘিরে যে দুঃখ তৈরী হয়েছিলো ২০১৮’র ৩০ জুলাই এসে তা রূপ নিলো দীর্ঘশ্বাসে। অন্ধকারে নিজের ছায়াও যেমন মিলিয়ে যায়-কামরান নামটি ঘিরেও এখন অন্তিম শূণ্যতা,কেবলই হাহাকার। তবে ২০১৫’ দুঃখের চেয়ে এবারকার দুঃখ একটি বেশীই কামরানের। কারন সিলেটের এক অনবদ্য ইতিহাস হওয়ার কথা ছিলো তার। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেছেন তিনি। প্রিয় প্রতীকটি নিয়ে কখনোই তিনি নিজের জন্য ভোট চাইতে পারেননি। স্বাধীনতার প্রতীক যে নৌকার জন্য তিনি ছাত্রজীবন থেকেই মাঠে ছিলেন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে নৌকার জন্য গান গেয়ে গেয়ে পথে ঘুরেছেন, নির্বাচনে কখনোই তিনি সে নৌকার মাঝি হতে পারেননি। এবার সে আক্ষেপ ঘোচানোর সুযোগ এসেছিলো কামরানের সামনে। এবারই প্রথম সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়। নানা নাটকীয়তা শেষে কামরানও পেয়েছিলেন প্রাণের প্রতীক। স্বপ্নও দেখেছিলেন। পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবার সে স্বপ্ন একটু বড়-ই ছিলো। যে প্রতীক নিয়ে আজীবন রাজপথ মাড়িয়েছেন তিনি। এবার সুযোগও ছিলো প্রিয় প্রতীক নৌকার মাঝি হয়ে হারানো মসনদে ফেরার। বিজয়ের খুব দ্বারপ্রান্তেও চলে গিয়েছিলেন তিনি। সারাদিন ভোট শেষে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন কামরানই বিজয়ী হচ্ছেন। কিন্তু দিন শেষে সব ওলটপালট। কামরানও হয়ে গেলেন বোতল বন্দি ভুতের মতো।

সিলেটের চাদিকে এখন একটাই অলোচনা- ‘কামরানের হার’। নানা হিসেব নিকেশে চলছে বিশ্লেষণও। দলীয় দাপট, কেন্দ্র দখল, জাল ভোটের মহোৎসব, প্রশাসনের পক্ষপাত- এতোসবের পরও কামরানের হার। সারাদিন ভোট শেষে সবাই যেখানে ধরেই নিয়েছিলেন কামরানেরই নিশ্চিৎ বিজয়ী হচ্ছেন সেখানে রাতে সব পাল্টালো কিভাবে-এমন নানা আলোচনা এখন সিলেটের বাতাসে। কেউ কেউ বলছেন নায়ক থেকে খলনায়ক বনে গেছেন কামরান। শাহজালালের পূণ্যভূমিত এমন নৈরাজ্য ঠিক হয়নি ক্ষমতাসীনদের। যে কারনে এমন ভরাডুবি হয়েছে।

এদিকে ভোটের পর থেকে সিলেট আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঝেও অভিমানের সূত্রপাৎ ঘটেছে। ঘরের মিরজাফরদের কারনে ফল পাল্টে গেছে বলে অভিযোগ করছেন অনেক নেতাকর্মী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুচ্চার হয়ে দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে-তাদের ‘বেইমান মোস্তাক’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন অনেকে। তাদের দাবী অনেক সিনিয়র নেতা গলায় নৌকা প্লেকার্ড ঝুলিয়ে কামরানের পাশে থাকলে ভেতরে ভেতরে বেইমানি করেছেন। যে কারনে তাদের নিয়ন্ত্রীত সেন্টারে বিজয় পেয়েছে ধানের শীষ। এর জন্য ছাত্রলীগ যুবলীগের অনেক নেতা প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলয়কে দোষারোপ করছেন। নেতা আসাদ উদ্দিন, আশফাক আহমদ,শফিউল আলম নাদেলের মতো সিলেট আওয়ামীলীগের নীতিনির্দারনি পর্যায়ের অনেক নেতাই গোপনে কামরানের শিদ কেটেছেন বলে প্রকাশ্যে ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন ছাত্রলীগ যুবলীগের অনেক নেতা। সব কিছু মিলিয়ে এবারের সটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আম-ছালা দুটিই হারিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। একদিকে কামরান হেরেছেন অন্যদিকে দলে তৈরী হয়েছে অবিশ্বাস। তবে সবকিছুর উর্দ্বে আলোচনায় এখন কামরানের রাজনৈতিক ক্যরিয়ার। অনেকেই বলছেন সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘নক্ষত্র’ কামরানের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার পথে।

সিলেটের রাজনীতির আকাশে নক্ষত্র হয়েই আলো ছড়িয়েছিলেন কামরান। কামরানের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কও অনেক দিনের পুরনো। ছাত্র অবস্থায়ই ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। দীর্ঘদিন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে এখনও সে দায়িত্ব সামলে চলেছেন। তবে কামরান আলোচনায় আসেন সেই তরুণ বয়েসেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পৌর নির্বাচনেই চমক দেখিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে যখন প্রথমবারের মতো পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন টগবগে তরুণ। স্থানীয় মুরব্বিদের অনুরোধে সিলেট পৌরসভার ৩নং ওর্য়াডের (তোপখানা) কমিশনার পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মুরব্বিদের চাওয়া বৃথা যায়নি, কোদাল প্রতীকে ৬৪৪ ভোট পেয়ে কামরান পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হন। পরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে, সেবারও কমিশনার নির্বাচিত হন কামরান। মাঝে কিছুদিন প্রবাসে চলে যাওয়ায় নির্বাচনী লড়াই থেকে দূরে ছিলেন তিনি। ১৯৮৯ সালে আবার ফিরেন নির্বাচনী ময়দানে। আরো একবার কমিশনার নির্বাচিত হন। এরপর কামরান তার দৃষ্টিকে আরো দূরে ছড়িয়ে দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে লড়াইয়ে নামেন। বিজয়ীও হন। এরপর শুধুই আলোর ইতিহাস। ১৮ বছর ধরে কামরানই ছিলেন সিলেটের নগরপিতা। এ সময়ের মধ্যে পৌরসভার যুগ পেরিয়ে সিলেট পা রেখেছে সিটি কর্পোরেশন যুগে। আর কামরানের ঝুলিতে জমা হতে থাকে একের পর এক সাফল্য। একজন ব্যাক্তি কামরান থেকে হয়ে উঠেন জনতার কামরান।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয় ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তখন ক্ষমতায়। তৎকালীন সিলেট-১ আসনের এমপি ছিলেন মরহুম এম. সাইফুর রহমান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহানগর আওয়ামীলীগ সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এবং বিএনপির প্রার্থী তৎকালীন জেলা সভাপতি এম.এ হক। এই নির্বাচনে চারদলীয় জোট কোমর বেঁধে মাঠে থাকলেও বিএনপির একাংশ নিজেদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বিএনপির বিভেদের কারণে অনুকূল সময়েও নির্বাচনের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। প্রথম নির্বাচনে ধাক্কা খেয়ে তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর এই সুযোগে সিলেট সিটিতে একক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন কামরান। পৌরসভার কমিশনার থেকে চেয়ারম্যান, অতঃপর মেয়র। এভাবে কামরান হয়ে উঠেন সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা তার। তৈরি হয় নিজস্ব ভোটব্যাংক। এ কারণে ২০০৮ সালের ৪ আগস্টে কারান্তরীণ থেকেও বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। প্রায় ৪ যুগের অভিজ্ঞতা। সিলেটের শেষ পৌর চেয়ারম্যান, আবার প্রথম সিটি মেয়র- দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কামরানের এমন অনন্য রেকর্ড। কিন্তু কামরানের এমন জনপ্রিয়তায়ও ধস নামে ২০১৩ সালের নির্বাচনে। ৫ মে’র ওই নির্বাচন তার জন্য একটি কালো অধ্যায়। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার পরও বিএনপি প্রার্থী আরিফের কাছে ধরাশায়ী হন তিনি। অনেকগুলো কারণ। সেই নির্বাচনে সিলেট আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ বিরোধিতা করে কামরানের। এই সুযোগে চরম অন্তরদ্বন্দ্বে ডুবে থাকা সিলেট বিএনপি আরিফকে একক প্রার্থী করে আট-ঘাট বেঁধে মাঠে নামে। চারদলের শরিক জামায়াতও সঙ্গি হয় তাদের। পাল্টে যায় পরিস্থিতি। কথামালা দিয়ে মানুষকে বশে রাখা কামরানের উপর থেকে অনেক ভোটার মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে নির্বাচনে আরিফের কাছে হেরে বসেন কামরান। তবে হেরে গিয়েও দমে যাননি তিনি। রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড় কামরান সরব হয়ে উঠেন আবার। সব অনুষ্ঠানেই তিনি-মধ্যমণি। সব মিলিয়ে কামরানের বিকল্প কামরান- এমন ভাবনা শুরু হয় দলের ভেতরে-বাইরে। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কামরান সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিয়ে নিজের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন সাফ। ‘তুমিতো সিলেটের মেয়র’- এমন আশ্বাস দিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য করেন তাকে। সেই থেকেই সিটি নির্বাচনে কামরানই যে আওয়ামীলীগের প্রার্থী, তা অনেকটা নিশ্চিত ছিলো। নির্বাচনের ঠিক মুহূর্তে মহানগর সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিনসহ একাধিক নেতা নৌকা চেয়ে বসলেও শেষ সময়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা কামরানের বিকল্প কাউকেই মনে করেননি। তাঁর হাতেই নৌকা তুলে দিয়ে সাফ জানিয়ে দেন কামরানের পক্ষেই কাজ করতে হবে সবাইকে। নেত্রীর নির্দেশে ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই সবাই একাট্টা হয়ে কামরানের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তের এমন ঐক্যের দৃশ্য আর নির্বাচনের পর পাল্টে যাওয়া ফলই এখন নানা আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on Facebook [১]Share on Google+ [২]Tweet about this on Twitter [৩]Email this to someone [৪]Share on LinkedIn [৫]