-জেসমিন চৌধুরী-(ফেসবুক থেকে)-

আবুল হাসান নামের একটি লোক আমার পোস্টে একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছে, ইনবক্সেও মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা আহ্লাদী ভাব, ভালোবাসা প্রকাশের আকুল চেষ্টা। আমি তার মন্তব্যের বা মেসেজের উত্তর দেই না, তবুও সে নিরস্ত হয় না। একটু একটু করে আমি তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছি কিন্তু তাকে ব্লক করতেও পারছি না কারণ সে খুবই ভদ্র। খুব একটা উচ্চশিক্ষিত বলে মনে হয় না কিন্তু আমার পোস্টগুলো বুঝবার চেষ্টা এবং সহমত তার কথাবার্তায় স্পষ্ট। তারপরও আবুল হাসানকে আমার ভালো লাগে না, একটা পুরুষ এমন করে কেন আমার প্রতিটা পোস্ট ফলো করছে? একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছে? মন্তব্যগুলোতে যতটা না পোস্টের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে আমার জন্য শুভকামনা, আমার দীর্ঘায়ুর প্রার্থনা, আমার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। আমি যখন কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই আবুল হাসানকে ব্লক করে দেয়ার কথা ভাবছি, তখনই একটা পোস্টে মন্তব্য এলো, ‘apa, bhoy paben na. ami ekta meye. apnake khub bhalo lage amar.’

নারীর নাম আবুল হাসান? আমার বিরক্তির মাত্রা বেড়ে গেল। সাহস তো কম নয়, এবার মেয়ে সেজে খাতির জমাতে চাইছে! তার পরপরই আবুল হাসানের কাছ থেকে ইনবক্সে একটা মেসেজ এলো- ‘Assalamu alaikum apu. Birokto hobenna please..ami bacchar ma. Bacchar bisoy apnar sate duti kota bolte chai…’কেউ একজন বাচ্চাদের ব্যাপারে আমার কাছে সাহায্য চাইছে, তাকে আমি একেবারেই চিনি না। হতে পারে এটা খাতির জমানোর একটা কৌশল, তবু সত্য হবার সম্ভাবনাও থেকেই যায়। এদিকে আমি তখন কলেজের চাকুরী, দোভাষীর কাজ, পারিবারিক ঝামেলা এবং বইমেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে মহাব্যস্ত। তবু আবুল হাসানের আবেদনকে আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। পৃথিবীর কোন কোণে ‘আবুল হাসান’ নামের এক নারী তার সন্তানদের নিয়ে কী ঝামেলায় আছে কে জানে! নিজের ইনবক্স নীতিমালা আপাতত বাতিল করে দিয়ে আমি আবুল হাসানকে মেসেঞ্জারে কল করলাম। সত্যিই একটা মেয়ে ফোন ধরল, পেছনে একটা পুরুষকন্ঠও শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার গলা শুনে দুজনেই যে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু তাদের কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছিলাম না, বারবার লাইন কেটে যাচ্ছিল।

এর পরের কয়েক মাসে আবুল হাসানের সাথে ইনবক্সে আমার অনেক কথা হয়েছে। তার বাচ্চাদের নিয়ে কিছু সমস্যা আছে, সে সম্পর্কে আমার সাধ্যমত তাকে আমি পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু আসলে বাচ্চারা আবুল হাসানের মূল সমস্যা নয়। স্বামী সন্তান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটা দেশে সে বেশ সুখেই আছে, যদিও এই সুখ পরোপুরি নিখাদ নয়। বিগত জীবনের স্মৃতি আবুল হাসানকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সে মনে শান্তি পায় না। আবুল হাসান নামক এই নারীর বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে, তার বিবাহিত জীবন নানান কারণে সুখের ছিল না, তবু সে ষোলো বছর মুখ বুজে সংসার করেছিল। এই ষোলো বছরে তার কোনো সন্তানও হয়নি। অবশেষে যখন সে স্বামীকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল, পাশে দাঁড়ালো তারই এক দেবর যাকে সে কোলে পিঠে মানুষ করেছে, কিন্তু নিজের বাবা চাচা ভাইরা রুখে দাঁড়ালো । তারা কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিল না। আবুল হাসান পালিয়ে গেল, তারা তাকে খুঁজে বের করে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলো।

তারপর শুরু হলো অমানবিক নির্যাতন। তাকে একটা ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো, বাইরে কড়া পাহারা, প্রচণ্ড মারধোর চলতে থাকল, মেরে অজ্ঞান করে ফেলে রাখা হলো তাকে। এভাবে চারমাস কেটে যাওয়ার পর যখন পাহারা কিছুটা শিথিল হয়ে এলো, তখনই আবার পালিয়ে গেল আবুল হাসান। পূর্ব পরিচিত একজনের হাত ধরে চলে গেল মধ্যপ্রাচ্যে। সেই একজনের সাথেই সে এখন সুখে ঘর করছে, কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। সে ভুলতে পারে না আপনজনদের হাতে অকথ্য নির্যাতনের কথা, বিশেষ করে যখন তার নিজের মা এখনো সেই কারাগারে বন্দী, তার নির্যাতক বাবার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যে মায়ের নেই। আমার মাকে নিয়ে লেখাগুলো পড়ে নীরবে কাঁদে আবুল হাসান, সে তার মাকে আর কখনোই দেখতে পাবে না, নিজের দেশে আর কখনোই পা রাখতে পারবে না। সামাজিক নিয়মের শৃঙ্খল ভেংগে নতুন জীবন শুরু করার যে অপরাধবোধটুকু আবুল হাসানের মনে কাজ করছিল, আমার পোস্টগুলো পড়ে তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে সে কোনো অন্যায় করেনি বরং তার সাথেই অন্যায় হয়েছে। সে আমাকে ইনবক্সে বলে ‘apnar lika pore bujte siki ami kuno oporad korini…amar iccha kore apnake niye jai amar somaje.amar poribare…apni bolen ami kuno oporad korini..ora keno amake ato nirjaton korlo…keno..keno…?’

এজন্যই আবুল হাসান চায় আমি যেন অনেক দিন বেঁচে থাকি, লিখে যেতে পারি, তার মত মেয়েরা, যাদের নিজের পরিচয় দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকবার মত পরিস্থিতিই নেই, যেন লেখাগুলো পড়ে সাহস পায়। আবুল হাসান আমাকে ইনবক্সে লেখালেখি নিয়ে পরামর্শ দেয়, আমি রাত জেগে লিখলে বকা দেয়, নিজের যত্ন নেইনা বলে শাসন করে। আবুল হাসান আমাকে তার জীবনের সব গল্প বলতে চায়, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায়, এমনকি আমাকে সে স্বপ্নেও দেখে। আমি কেন মধ্যপ্রাচ্যের উপর দিয়ে উড়ে চলে যাই, থেমে তাকে একটা বার দেখে আসি না আবুল হাসান বুঝতে পারে না। আমি কেন বুঝি না সে কখনোই আমার কাছে আসতে পারবে না, আমাকেই জীবনে একটাবারের জন্য হলেও তার কাছে যেতে হবে? আমার কাছে আবুল হাসানের প্রশ্ন নিরন্তর। নিজের নাম প্রকাশ করতে ভয় পায় আবুল হাসান, যদি তার বাপ ভাইরা তাকে আবার খুঁজে বের করে ফেলে! তাই স্বামীর ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করে সে আমার সাথে যোগাযোগ রাখে, আমার লেখা পড়ে, মন্তব্য করে। আমার কিছু বিদগ্ধ ফেসবুক বন্ধুদের সাথেও সে যুক্ত হয়েছে, নিয়মিত তাদের লেখা পড়ে। আমি আবুল হাসানকে চোখের সামনে বাড়তে দেখছি, তার বিকাশ দেখছি, আমার ভালো লাগছে। সময়ের অভাবে আমি তার বড়বড় মেসেজের উত্তর দিতে পারি না, হয়তো তার সাথে দেখা করতে আমি কখনোই মধ্যপ্রাচ্যেও যাব না কিন্তু আবুল হাসান নামের এই মেয়েটির জন্য আমার মন ভীষণ কাঁদে। যে সমাজ আবুল হাসান নামের মেয়েদের জন্ম দেয় সেই সমাজকে আমি ধিক্কার জানাই।

আমি মেয়েটার কাছে এখনো তার আসল নাম জানতে চাইনি। আমার কাছে সে আবুল হাসানই থেকে গেছে, কী লাভ তার পরিচয় জেনে? তার এই নামহীনতা তার সমস্ত অপ্রাপ্তির জ্বলন্ত সাক্ষ্মী হয়ে আমার বিবেককে সদা দংশন করুক। এই সমাজের একজন মানুষ হিসেবে এইটুকু শাস্তি অন্তত আমার প্রাপ্য। (মেয়েটির স্বামীর ফেসবুক আইডির নাম আবুল হাসান নয়, কল্পিত নাম ব্যবহার করা হয়েছে।)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn