সুজাত মনসুর :: ৩০শে জুলাই, ২০১৮ বাংলাদেশের কতিপয় জাতীয় দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায়ও হয়তো প্রচারিত হয়েছে, যা আমার শোনার বা দেখার সুযোগ ও সময় হয়নি। সংবাদটি হলো, প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিস্ট জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘নিউ ব্লাড তত্ব’ ও সরকারি দলের আশিভাগ সাংসদকে অসৎ উল্লেখ করে তাদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যাকে ক্ষমতায় আনা যায়। তবে সেজন্য বর্তমান এমপিদের মধ্যে আশিভাগ অসৎ এমপিকে বাদ দিয়ে শিক্ষিত, সৎ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া উচিত। রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। সাংবাদিক সম্মেলনটি ডাকা হয়েছিলো বিলেত প্রবাসী শফিকুল ইসলাম নামক জনৈক প্রকৌশলীকে নারায়নগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। যিনি নাকি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিগুলো নিয়ে অনেক কিস্সা-কাহিনী প্রচলিত আছে। এমনকি পদ-বানিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। ওবায়দুল কাদের একবার এই উপ-কমিটি সম্পর্কে ক্ষোভ করে বলেছিলেন, “ধাক্কা লাগল্ইে বলে উপ-কমিটির সদস্য”। দলের নেতাকর্মীদের স্থান সংকুলানের জন্য ও সংগঠনের কাজে সবাইকে সম্পৃক্ত করে সাংগঠনিক কাজে গতি সঞ্চালনের জন্যই মূলতঃ উপ-কমিটিগুলো করা হলেও, দলের জন্য বদনামের মাত্রা বাড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদবী ব্যবহার করে নানাবিধ পোস্টার প্রকাশ করা ব্যতিত সংগঠনের তেমন কোন উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। সম্ভবতঃ মাস দু‘য়েক আগে দৈনিক জনকণ্ঠে, যুক্তরাজ্য থেকে যে তিনজন ভাগ্যবান তিনটি ভিন্ন উপ-কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে নিয়েছেন, সে বিষয়ক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। তাদের মধ্যে জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর আশির্বাদপুষ্ঠ প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম একজন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত নেতাকর্মীদের সবাই মোটামোটি আমার পরিচিতজন। তাঁদের বেশিরভাগেরই অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। শফিকুল ইসলাম নামের কেউ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের নেতা তা আমি কেন, অনেকেরই জানা নেই। এমনকি দেশেও এমন কোন রাজনৈতি ট্য্রাক রেকর্ড নেই। যার আলোকে ঘটা করে তার পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন করে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মনোনয়ন কামনা এবং সরকারীদলের এমপিদের শতকরা আশিজনকেই অসৎ বলে চিহ্নিত করা কোন ধরনের প্রমাণ ছাড়া কতটুকু যৌক্তিক, শালীন ও সুন্দর প্রশ্নটা থেকেই যায়। তবে তাঁর এবারের বাংলাদেশ সফর যে জনাব শফিকুল ইসলামকে নৌকার প্রার্থী করতে তদবিরের উদ্দেশ্যে তা বিলেতের বাজারে মোটামুটি প্রচারিত ছিলোই। সাংবাদিক সম্মেলন করার পর সে গুজব সত্যে প্রমাণিত হলো।

জনাব চৌধুরী অবশ্য উনার মক্কেল শফিকুল ইসলামের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, শফিক সাহেব নাকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করার সময় আর্থিকভাবে ব্যাপক সহায়তা করেছেন। আর এটাই হলো জনাব শফিকের মনোনয়নপ্রাপ্তির জন্য অন্যতম ও প্রধান যোগ্যতা। যতটুকু জানি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এই ডকুমেন্টারি করার জন্য তাদের সাধ্যমত কন্ট্রিবিউট করেছেন। তাহলে তো জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর উচিত ডকুমেন্টারি তৈরিতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার জন্য প্রেস কনফারেন্স করে মনোনয়ন দাবি করা। এছাড়া আর্থিক অনুদান দিয়ে যদি মনোনয়ন প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জণ করা যায় তাহলে মাঠে রাজনীতি করে বা জেল-জুলুম সহ্য করে রাজনীতি করে লাভ কি? অন্যদিকে জনাব শফিকুল ইসলাম দেখলাম তার বক্তব্যে বলেছেন, মুজিবাদর্শের রাজনীতির আগামীদিনের সম্ভাব্য কান্ডারি জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশে নাকি এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধৃষ্ঠতা কোন পর্যায়ে গেলে পরে মনোনয়নপ্রাপ্তির জন্য একজন নবাগত রাজনৈতিককর্মী, যার একমাত্র যোগ্যতা কিনা আর্থিক সঙ্গতি সে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, বঙ্গবন্ধুর নাতি যার নাম বঙ্গবন্ধু নিজে রেখেছেন সেই নামটি ব্যবহার করতে পারে। এই যে কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা, সেটাও তো আর্থিক অসততার চেয়ে আরো বড়ধরনের অসততা। অসৎ পন্থা অবলম্বন করে জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির পক্ষে জনাব চৌধুরীর প্রকাশ্যে অবস্থান নৈতিকতার আলোকে কতটুকু সঠিক তা বিবেচনার দাবি রাখে বৈকি। উল্লেখ্য, জনাব চৌধুরী যে ডকুুমেন্টারির কথা বলেছেন, দুই বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও সেই ডকুমেন্টারি এখনো আলোর মুখ দেখেছে বলে জানা নেই।

আবদুল গাফফার চৌধুরী আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবী এটাতো স্বীকৃত সত্য ও প্রমাণিত। তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোন কথা বলেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হয়ে যায়। যা বিরোধীদের জন্য সোনায় সোহাগা। (তিনি ইতোপুর্বেও লন্ডনে সাবেক প্রেস মিনিস্টার নাদিম কাদিরের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করেছে বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিচারপতি সিনহা যখন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল ক্র্যু করতে চেয়েছিলো তখনও তিনি সিনহার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমি দুটোরই প্রতিবাদ করেছি এবং উনার নিকট ব্যাখ্যা ও প্রমাণ চেয়েছি। কিন্তু তিনি প্রমাণ ছাড়াই অনেককিছু বলেন। কেননা, তাঁর অবস্থান থেকে খুব সহজেই অনেককিছু বলা যায়, মানুষ তা বিশ্বাস ও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই)। তার এ ধরনের বক্তব্যের সাথে বিএনপি ও সুশীলদের বক্তব্যের কোন ভিন্নতা খুঁজে পাইনা। আওয়ামী লীগের সব এমপি যে সৎ তা বলার অবকাশ নেই। তাদের অনেকেই যে কর্মী কিংবা জনবান্ধব নন তাও সত্য। কিন্তু আশিভাগই যদি অসৎ হয় তাহলে সরকারের উন্নয়ন হচ্ছে কি করে? শেখ হাসিনাই বা এতো অসৎ এমপি পরিবেষ্ঠিত হয়ে সরকার পরিচালনা করে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় সৎ সরকার প্রধান হিসেবে চিহ্নিত হলেন কি করে? জনাব গাফফার চৌধুরী তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগে সংস্কারের কথা বলেছেন। যুবলীগ-ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকান্ডেরও সমালোচনা করেছেন। আবার দলে নতুন রক্ত সঞ্চালন অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মনোনয়ন দেবার দাবি করেছেন। উনার এ কথাগুলোর সাথে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। আর আওয়ামী লীগ ঘরানার সব সংগঠনেই যে সংস্কার দরকার তা দলীয় সভানেত্রী আরো বেশি অনুভব করেন। যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মকান্ড যে বিতর্কিত ও দলের ভাবমুর্তি নষ্টের মূল কারণ তাও তিনি অবগত আছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি তা বারবার বলার চেষ্টাও করছেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত কম বিতর্কিত, পরীক্ষিত ও দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা আছে সে পরিবারের সন্তানদের নেতৃত্বে নিতে আসতে চান বলেই ছাত্রলীগের নতুন কমিটি করতে সময় নিচ্ছেন যাতে করে নেতৃত্ব নির্বাচনে কোন ধরনের ভুল না হয়। তিনি ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু করেছেন। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সংগঠনেই তা করবেন সে ভরসা আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি রাখতেই পারি। সেজন্য সাংবাদিক সম্মেলন করে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির মনোনয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গণহারে আওয়ামী লীগের এমপিদের অসৎ বলে চিহ্নিত করা শোভনীয় নয় বলেই মনেকরি। তাঁর এ বক্তব্য অন্যসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যের মতো বলেই ধরে নেয়া যায়। কেননা, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, তিনি বিশজন এমপিরও অসততার অকাট্য প্রমাণাদি হাজির করতে পারবেন না, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ব্যতিত।

তিনি নতুন রক্ত সঞ্চলনের কথা বলেছেন। মনোনয়ন দেবার সময় শিক্ষিত, সৎ তরুণদের বেছে নেবার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এধরনের বক্তব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ও তরুণদের মধ্যে যারা মনোনয়ন প্রত্যাশি তাদের জন্য সুখকর। কিন্তু অন্যদিকে তিনি যুবলীগ-ছাত্রলীগকে অভিযুক্ত করেছেন বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য। রাজনৈতিক দলে নতুন নেতাকর্মীদের আগমণ ঘটে মুলতঃ ছাত্র ও যুব সংগঠনের মাধ্যমে। এ সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক কর্মী তৈরির কারখানা বলা যেতে পারে। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনকে। উনার ‘নিউ ব্লাড’ থিয়োরি মতে যদি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়, তহালে যুবলীগ-ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা নেতাকর্মীদের মধ্য থেকেই দিতে হবে। কিন্তু তাঁর কথামতোই আমরা ধরে নিতে পারি বর্তমান যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য পঁচে গিয়েছে। সুতরাং যুবলীগ-ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব থেকে মনোনয়ন দিয়ে কথিত অসৎ এমপিদের স্থলাভিষিক্ত করা যাবে না। শুধূমাত্র রাজনীতি বিবর্জিত কিংবা যৎসামান্য রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা থাকার কারনে অথবা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে হঠাৎ রাজনৈতিক নেতা বনে যাওয়াদের দিয়েই কি ‘নিউ বøাড’ থিয়োরির প্রয়োগ হবে? এটা তো দেশের রাজনীতির জন্য আরো ভয়াবহ। এই ফর্মুলায় তো দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত ত্যাগি নেতাকর্মীদের পরিবর্তে রাজনৈতিক টাউট আর সুবিধাবাদিদের জন্য সুবর্ণ সুৃযোগ করে দেয়া, প্রকারান্তরে যা সুশীলদের বিরাজনীতিকরণ নীতি বাস্তবায়নেরই নামান্তর।

জনাব চৌধুরী যাদেরকে অসৎ বলে চিহ্নিত করে তাঁদের বাদ দেয়ার কথা বলছেন, তাদের কিন্তু ত্যাগ-তিতিক্ষায় পরীিিক্ষত একটি বর্নাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। অনেকে বছরের পর বছর জেলের ঘানি টেনেছেন। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। জনগনের ভালোমন্দের ভাগিদার হয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভুমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করেছেন। শেখ হাসিনার পাশে থেকে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে আবারো বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন। দলকে ক্ষমতায় এনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছেন। দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে ভুমিকা রাখছেন। তারা সুবিধাবাদি রাজনীতিবিদ আর ফায়দা লুন্ঠনকারিদের মতো বসন্তের কোকিল নন। সুতরাং কোন্ ব্যক্তি বিশেষকে সুবিধা পাইয়ে দেবার জন্য, কোন ধরনের অকাট্য প্রমাণ ছাড়া জনগনের ভোটে নির্বাচিত আশিভাগ সাংসদেরকে অসৎ বলে চিহ্নিত করা গোটা সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর এই কাজটি সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী করবেন তাও জাতি প্রত্যাশা করে না। নতুন রক্ত সঞ্চালণ আমরাও চাই, তবে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের দিয়ে নয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশীলিত নির্ভেজাল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ নতুন রক্ত দিয়ে। নতুন কোন দুষিত রক্ত নয়। জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর এ ধরনের অনৈতিক আবদার বুড়ো বয়সের ভীমরতিই বলা যেতে পারে।

লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক
suzatmansur@yahoo.com

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn