- সুনামগঞ্জ বার্তা - http://sunamganjbarta.com -

ছদ্মনামের এক নারী এবং অভিনব প্রতারণা

এক অভাবনীয় সঙ্গবদ্ধ অপরাধের শিকার বেশ কয়েকজন ব্যাক্তি যারা কেউই জানত না এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ। ঘটনার সূত্রপাত সিলেটে। ফলিক মিয়া চৌধুরী নামের এক ব্যাক্তি এবি ব্যাংক, দরগাঘাট শাখায় তার একাউন্টে ২৫ লক্ষ টাকার গড়মিল দেখতে পান। অথচ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী তার স্বাক্ষরিত চেকেই ২৪ মে, ২০১৮ তারিখে ২৫ লক্ষ টাকা ট্রান্সফার হয় রুমানা আক্তার নামের এক নারীর একাউন্টে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চাঁদপুর শাখায় রুমানা মাত্র মাসখানেক আগেই একাউন্টটি খুলেছিলেন যেখানে টাকা জমা হয়। পরে ২৮ এবং ২৯ মে দুইদিনে একই ব্যাংকের চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের চারটি শাখা থেকে পুরো টাকাটিই তুলে নেয় রুমানা। কিন্তু তার একাউন্ট ফরমে দেয়া মোবাইল নাম্বার এবং জন্মনিবন্ধন সনদে উল্লেখিত ঠিকানা কোনটিরই বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যায় না অনুসন্ধানে।ততদিনে ফলিক মিয়া অভিযোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকে আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই চাঁদপুর সদর থানায় মামলা করেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক চাঁদপুর শাখার ম্যানেজার। তিনিসহ বেশ কয়েকজন নিরপরাধ মানুষের চাকরি তখন হুমকির মুখে। তারপরেই শুরু হয় ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা আর প্রযুক্তির অসাধারণ ব্যাবহার। চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক মোঃ মহিউদ্দিনকে তদন্তের ভার দেন পুলিশ সুপার চাঁদপুর, জিহাদুল কবির পিপিএম স্যার। তদন্তের শুরুতে কোন দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলেন না মহিউদ্দিন৷ জেলা গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ নূর হোসেন মামুন নিজেও সার্বক্ষনিক যুক্ত থাকেন তদন্তের স্বার্থে। একটি ভূয়া চেক, ভূয়া নাম-ঠিকানায় করা জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে খোলা ভূয়া একাউন্ট এবং সম্ভবত ছদ্মনামের এক নারী-এর বাইরে কিছুই ছিল না যা থেকে তদন্ত শুরু করা যায়। একাউন্ট ফর্মটিই প্রথম পথের দিশা দেয়, সাথে পাওয়া যায় ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজে শিশু কোলে বোরকা পরা নারীর ছবি। প্রযুক্তির ব্যাবহারে, সতর্ক পদক্ষেপে ছোট্ট একটা তথ্যের সূত্র ধরে পাওয়া যায় আরেকজন নারী প্রতারকের সন্ধান। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এক ব্যাংকে ভুয়া চেক দিয়ে টাকা তুলতে গিয়ে গ্রেফতার হয় সেই নারী। এই সাকিমা বেগমের খোঁজ আলোর দিশা দেখায় তদন্তে।
সাকিমাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয় চাঁদপুরে। তার দেয়া তথ্যে তার দুই সহযোগীর মধ্যে একজন রাসেল মিজি ওরফে সুমনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার দেয়া তথ্যে পাওয়া যায় এই চক্রের চাঁদপুরের মূলহোতা রাশেদকে। তারপরে শ্বাসরুদ্ধকর কয়েকটি ঘন্টা, জিজ্ঞাসাবাদ, নানা তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণ আর অভিযানের পরে গ্রেফতার হয় গল্পের মূল নায়িকা সেই ছদ্মনামধারী রুমানা আক্তার ওরফে হালিমা খাতুন (রূপা)। অবশেষে ২২শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবনন্দী দেয় রুমানা ওরফে হালিমা এবং রাসেল ওরফে সুমন। তাদের বক্তব্যে সংশ্লিষ্টতা পেয়ে গ্রেফতার করা হয় রুমানার মা পারুল এবং রাশেদের ভাই সাদিওর রহমানকে।
এই চক্রটি শুধু চাঁদপুর এর কয়েকটি ব্যাংক থেকেই সর্বমোট ৫৭ লাখ টাকা তুলেছে প্রতারণার জাল বিছিয়ে। রুমানা আক্তার নামে কয়েকটি ভুয়া একাউন্ট রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে। তদন্তে জানা যায়, প্রতারণা চক্রটি প্রবাসী বাঙ্গালীদের পাঠানো চেকের ছবি বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করে ঠিক তার পরবর্তি নাম্বারের জাল চেক তৈরি করে। এরপরে স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া তথ্য দিয়ে খোলা ভুয়া একাউন্টে টাকা জমা দেয় সেই চেকের মাধ্যমে। টাকা জমা হবার পরেই দ্রুততার সাথে ব্যাংক থেকে সেই টাকা তুলে নেয় চক্রের অন্য কোন সদস্য। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় অভিনব এক সঙ্গবদ্ধ উপায়ে। তবে এবার আর পার পেতে পারেনি এই চক্র, ধরা পরতে হলো সবাইকে।
পুলিশ সুপার চাঁদপুর, জিহাদুল কবির পিপিএম স্যারের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নে এবং পরামর্শে এই সঙ্গবদ্ধ অপরাধ চক্রকে সনাক্ত করতে পারায় পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিনকে তাৎক্ষনিকভাবে দশ হাজার টাকা পুরষ্কার প্রদান করেন স্যার নিজেই। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, চাঁদপুর শাখার ম্যানেজার ও তার সহকর্মীদের চাকরি এবং সম্মান দুটোই বেঁচে যায় পুলিশের কর্মতৎপরতায়। তারা সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যান ফুলেল শুভেচ্ছায়। প্রতারকের জাল যতই কঠিন হোক, অপরাধী কোন না কোন সূত্র রেখেই যায়। আর মহিউদ্দিনের মত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহারে খুঁজে নিয়ে আসে সেইসব অপরাধীদের৷ অসংখ্য ফলিক মিয়াদের বাঁচিয়ে দেয় রুমানাদের প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে।

লেখক: শাকিলা ইয়াসমিন সূচনা, সহকারি পুলিশ সুপার (সদর), চাঁদপুর

(পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির পিপিএম-এর ফেসবুক স্ট্যাটাস)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on Facebook [১]Share on Google+ [২]Tweet about this on Twitter [৩]Email this to someone [৪]Share on LinkedIn [৫]