সরকারি অনুদানভুক্ত সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নাম মুছে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। কিন্তু এক মাসেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা সুনামগঞ্জে বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের সাথে সুনামগঞ্জ জেলার ৫টি স্থাপনার নাম পরিবর্তনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নামে সরকারি অনুদানভুক্ত সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়ে থাকলে তা মুছে ফেলে জরুরী ভিত্তিতে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক ও উপজেলা       
নির্বাহী অফিসারগণকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত এই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রতিবেদন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নামে প্রতিষ্ঠা হওয়া সুনামগঞ্জের একটি সড়ক ও চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিস কমিটির সভাপতি আনোয়ার রাজা চৌধুরীর নামে শহরের নতুন হাছননগরে আনোয়ার রাজা চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর দালাল আবু হানিফার নামে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর কলোনী এলাকায় আবু হানিফা রোড, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর দালাল জামালগঞ্জের শাহপুরে হাজী আব্দুল বারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জামালগঞ্জের রাজাকার লাল মিয়ার ছেলে পাক বাহিনীকে সাহায্যকারী ও মুক্তিযুদ্ধা নিধনে প্রত্যক্ষ জড়িত বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নামে আলহাজ্ব ঝুনু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও একই উপজেলার পাকিস্তানের জিন্নাহের নামে রুপাবালী গ্রামের জিন্নাহ মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চিহ্নিত তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে বর্তমানে কোন বিতর্কিত ব্যক্তি নেই। কেবল আলহাজ্ব ঝুনু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঝুনু মিয়া আছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ ওই প্রতিবেদেনের মন্তব্য কলামে উল্লেখ করা হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নামে নামকরণকৃত এসব সড়ক ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে এলাকার কোন বিশেষ মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করা যেতে পারে।
এদিকে আনোয়ার রাজা চৌধুরীকে পিস কমিটির সভাপতি উল্লেখ করা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে মুক্তিযুক্ত চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র সুনামগঞ্জ এর আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন,‘আবু হানিফা পিস কমিটির সদস্য ছিলেন, একথা সঠিক। কিন্তু আনোয়ার রাজা চৌধুরী পিস কমিটির সভাপতি বা সদস্যও ছিলেন না। পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন শওকত মিয়া। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা ও অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের বিশেষ কর্মসূচীর (শান্তি ভবনের) জেলা পর্যায়ের মূল ব্যক্তি ছিলেন আনোয়ার রাজা চৌধুরী।’
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসূণ কুমার চক্রবর্তী বলেন,‘ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম মুছার বিষয়ে জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চিঠি পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছিল। রুপাবালী গ্রামের জিন্নাহ মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিন্নাহ’র নাম পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য দুইটির নাম পরিবর্তনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান বলেন,‘ সুনামগঞ্জ শহরের আবু হানিফা রোড ও আনোয়ার রাজা চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য জানার জন্য পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তারা জানিয়েছেন আবু হানিফা নামে কোন রোড নেই, তবে বিদ্যালয়টি রয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিষয়টি অবগত করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের ফেরত চিঠি পাওয়া যায়নি। ’
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হাসান বলেন,‘ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এধরনের কোন চিঠি এখন পর্যন্ত পাইনি। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হবে।’
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ুব বখত জগলুল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার চিঠি পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে জানান, ‘শহরের বিলপাড়ের আবু হানিফা রোড নামে কোন রোড নেই। পৌরসভায় এধরনের রেজুলেশন পাওয়া যায় নি। ওই রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে বিলপাড় প্রধান রাস্তা নামে। তবে শহরের নতুন হাছননগরে আনোয়ার রাজা চৌধুরীর নামে একটি বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়টি পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ ও অনুদানভুক্ত নয়। তবে বর্ণিত তালিকায় বিদ্যালয়টির বিষয়বস্তু ও পটভূমি পুরোপুরি সঠিক। তাই এর নাম মুছে ফেলার দায়িত্ব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের। ’
জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক বাবর আলী মীর বলেন,‘মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর পরই সদর ও জামালগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নাম মুছে ফেলা এবং ফেরত চিঠিতে বিষয়টি অবগত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ফেরত কোন পত্র পাওয়া যায় নি। দ্রুত বিষয়টির খোঁজ খবর নেয়া হবে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn