না ফেরার দেশে চলে গেছেন নব্বই দশকের টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ। ২২ মে, তার মৃত্যুর পর থেকেই মিডিয়ায় নানা ধরনের সংবাদ প্রচার হচ্ছে। দীর্ঘ ২২ বছর মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাজিন আহমেদের হঠাৎ এ চলে যাওয়াটা হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে খুব বিস্ময়ের, কিন্তু শেষ কয়েক বছর প্রতিনিয়ত যে অমানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তিনি গেছেন, সেটা তার সহকর্মী এবং বন্ধুদের কাছে অজানা নয়। তাজিন আহমেদ সম্পর্কে নতুন আরও কিছু তথ্য জানালেন তরুণ নির্মাতা তৌফিক নেওয়াজ। শিনশিন হাসপাতাল থেকে তাজিনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাশে থাকা তৌফিক সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন। তৌফিক জানান, শেষ তিন বছর কোনো কাজ ছিল না তাজিনের। বেড়েছিল স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব। অন্য নারীর করা নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছিল স্বামী রুমির বিরুদ্ধে, তিনি জানতেন তার স্বামী অপরাধী, তবুও বিভিন্ন জায়গায় তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, পালিয়ে থেকেছেন। এরই মধ্যে চেক ডিজঅনার একটি মামলায় তাজিনের মা কারাগারে যান। এই ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়েই পরপর দুটি চাকরি হারান তাজিন। একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র থেকে হঠাৎ করেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও কাজ পাচ্ছিলেন না। দীর্ঘ দিনের সহকর্মী এবং বন্ধুরাও তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। মাসে একদিন বা দুদিন কাজ থাকতো তার, কোনো কোনো মাসে তাও থাকতো না। বাড়ি ভাড়া দেওয়াও সম্ভব হতো না অনেক সময়। এমনকি টাকার জন্য না খেয়েও থাকতে হয়েছে। শেষের দিকে স্বামী রুমির সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও রুমি তাকে এড়িয়ে চলতেন, তাজিনের নম্বরও ব্লক করে রেখেছিলেন। এই নির্মাতা বলেন, ‘শারীরিকভাবেও খুব একটা সুস্থ ছিলেন না তাজিন। শৈশব থেকেই শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিল তার, মাঝেমাঝেই নেবুলাইজেশন করানো হত। কিন্তু সেটাও তিনি ঠিক মতো করাতে পারতেন না অর্থের অভাবে। এগুলো সবই জানতেন মিডিয়ায় যারা তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং বন্ধু আছেন, কিন্তু গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। এই অর্থের অভাবেই মৃত্যুর আগে তাকে প্রায় এক ঘণ্টা আটকে থাকতে হলো উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের শিন শিন জাপান হাসপাতালে।’

অসুস্থ অবস্থায় তাজিন আহমেদকে বাসা থেকে মেকআপ আর্টিস্ট মিহির মোহন নিয়ে যান শিনশিন জাপান হাসপাতালে। সেখানে তাৎক্ষণিক অ্যাজমার চিকিৎসা করানো হলেও দ্রুতই তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেখানে একা থাকা মিহির কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তাই ফোন দিচ্ছিলেন তাজিনের সকল ঘনিষ্ঠজনকে। ফোন পেয়ে হাসপাতালে আসেন তৌফিক নেওয়াজ। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করে তৌফিক জানান, আইসিইউতে থাকা তাজিনের অবস্থা যখন ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছিল, তখন সেখানে একজন ডাক্তার তাদের ডেকে জানান, অন্য হাসপাতালে তাজিনকে স্থানান্তরের কথা। এ সময় মিহির তাজিনের পরিচিত একজনকে ফোন করলে তিনি পাশের রোডেই তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু এ সময় পর্যাপ্ত টাকা ছিল না মিহির বা তৌফিক দুজনের কাছেই, ফলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছিল না তাজিনকে। টাকার জন্য সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের। এ সময় অন্য কোথাও তাকে দ্রুত স্থানান্তর করলে হয়তো কিছু একটা হতে পারতো বলে আফসোস করেন তৌফিক। পরবর্তী সময়ে অভিনেত্রী হোমায়রা হিমুকে ফোন করেন তৌফিক, তিনি টাকা ম্যানেজ করে আসতে আসতে শেষ মুহূর্তে নতুন অনেকগুলো ঔষধ লিখে দেওয়া হয় আইসিইউ থেকে। সতেরশো টাকার সেই ঔষধ কিনে আনার পাঁচ মিনিট পরেই হুইল চেয়ারে করে নিচে নামানো হয় তাজিনকে। এতগুলো ঔষধ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কীভাবে তাকে দেওয়া হয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তৌফিক। পার্শ্ববর্তী রিজেন্ট হাসপাতালটিও খুব বেশি যত্নশীল ছিল না বলে জানান তোফিক, একজন কম বয়সী ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলেন যিনি তাজিন আহমেদকে দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর এসে তিনি বলছিলেন ‘উনার কার্ডিয়াক এটাক হয়েছে, যে কোনো সময় কিছু হয়ে যেতে পারে।’ তাজিন আহমেদের অসুস্থতার খবর শুনে ততক্ষণে হাসপাতালে ভিড় করতে থাকেন টেলিভিশন শিল্পী ও মিডিয়া জগতের অনেকেই। বিকালে মৃত্যুর খবর শোনার পর অপেক্ষা করা হয় তার আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠজনদের জন্য। কিন্তু মৃত্যুর আগে ও পরের দৃশ্যটাও ঠিক একই রকম, তাজিনের দায়িত্ব নিতে কেউ আসেননি। কিছু সময় অপেক্ষার পর এগিয়ে আসেন অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম, তিনি দায়িত্ব নেন তাজিনের সকল কিছুর, এর পরই সচল হয়ে ওঠে অভিনয়শিল্পী সংঘের সদস্যরাও।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn