তিনগুণ যাত্রী বহন করছে ট্রেন * বাস-লঞ্চে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ * দুর্ভোগ যে কোনো সময়ের চেয়ে কম -ওবায়দুল কাদের
 ঈদের বাকি আর মাত্র একদিন। স্বজনদের সঙ্গে দিনটি উদযাপনে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। টিকিট সংকটের পাশাপাশি আছে পথে সীমাহীন ভোগান্তি। তরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে কিংবা ইঞ্জিন কভারে যাচ্ছেন। এর মধ্যে পথে পথে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এত বিড়ম্বনার মধ্যেও আলাদা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন যাত্রীরা। শেকড়ের টানে আপন ঠিকানায় ছুটছেন অবিরাম। রাজধানীর কমলাপুরের রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী : পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, সঠিক সময় বাস ছেড়ে যাচ্ছে। টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। আমার জানা মতে ভাড়া বেশি নিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের মূল সমস্যা যানজট। যানজটে কারণে এ রুটের মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকা থেকে বান্দরবান যাচ্ছেন পারভেজ নামের আরেক যাত্রী। তিনি বলেন, ভয় হচ্ছে রাস্তার ভোগান্তি নিয়ে। আমার সঙ্গে ছোট ছেলে-মেয়ে। রাস্তায় যদি যানজটে পড়ি, ওরা কষ্ট পাবে। দোয়া করবেন রাস্তায় যেন ভোগান্তিতে না পরি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ইউনিক পরিবহনের ম্যানেজার নাসির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সকালে যাত্রীর বেশি চাপ ছিল। দুপুরে তেমন যাত্রী নেই। তবে রাতে চাপ বাড়বে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত গাড়ি রয়েছে। সঠিক সময় ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। তবে ঈদযাত্রায় মূল সমস্যা হয় মহাসড়কে যানজট থাকলে। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। সামনের দুই দিন যানজট না থাকলে আশা করি কোনো ঝামেলা হবে না। যাত্রাবাড়ী এলাকার হানিফ পরিবহনের ডেস্ক ম্যানেজার শামীম হোসেন বলেন, রাস্তায় যানজট না হলে সঠিক সময়ে গাড়ি আসবে, ছেড়ে যাবে। যাত্রীদের কোনো ভোগান্তি হবে না। এখন পর্যন্ত সড়কগুলো ক্লিয়ার আছে। সামনে দু’দিন ঠিক থাকলে এবারের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি হবে না।

রেলে যাত্রী তিনগুণ : ঈদ উপলক্ষে আসন ক্ষমতার তিনগুণ যাত্রী যাচ্ছে রেলে। আর প্রতিদিনই সিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। ঈদের বিশেষ ট্রেনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি ঘটছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা ইচ্ছা করেই এ কাজ করছে। জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা ১০ জুন থেকে যাত্রা শুরু করেছেন। কিন্তু বুধবার থেকে বিভিন্ন ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। প্রায় ট্রেনই দেড় থেকে ২ ঘণ্টা পযর্ন্ত বিলম্বে চলাচল করছে। আজ ও আগামীকাল সমস্যা আরও বাড়বে।

রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। ১ ঘণ্টা কিংবা ৩০ মিনিট বিলম্বে ট্রেন চলাচল করাটাকে খুব একটা দুর্ভোগ বলা যাবে না। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে নির্ধারিত গতির চেয়ে কম গতিতে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিটি ট্রেনই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। এক একটি স্টেশনে নির্ধারিত যাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত সময় দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ভিড়ে যাত্রীদের ওঠানামায় বেশি সময় লাগছে।

ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই নির্ধারিত সময় ট্রেন চালানো অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। ছাদে, ইঞ্জিনে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়। গতি বাড়িয়ে কিংবা স্টেশন নির্ধারিত বিরতি দিয়ে ট্রেন চালাতে গেলেই মহাবিপদ হতে পারে। যা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কখনও করতে পারে না। বুধবার থেকে ৯টি ঈদ স্পেশাল ট্রেন বিভিন্ন রুটে চলাচল শুরু করে। এই ট্রেনগুলো তিনগুণ যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। ফলে ট্রেনের চালক কিংবা গার্ড ট্রেন চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে।

ঢাকা থেকে বুধবার দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেসটি সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। লালমনিরহাট স্পেশাল ট্রেনটি ৯টা ১৫ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে গেছে।

শাহ আলম, কামাল হোসেন, রুবিনা আক্তার, পারভীন, জামাল উদ্দিন, নজরুল ইসলামসহ ২০-২৫ জন যাত্রী জানান, ট্রেনে নিরাপদ ভ্রমণ বলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন। কিন্তু যখন দেখছি ট্রেনও বিলম্বে চলাচল করছে, তাতে কষ্ট পাওয়ার কথাই। এদিকে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে প্রায় প্রতিটি ট্রেনের ছাদেই যাত্রীরা উঠছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন নিরুপায়। তাদের সামনেই দরজা-জানালা দিয়ে ছাদে উঠছে লোকজন। কেউ কেউ আবার মই দিয়ে ছাদে উঠছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদের কিছুই করার নেই। কিছু করতে গেলেই যাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আমরা শুধু অনুরোধ করছি, ছাদে না ওঠার জন্য।

কমলাপুর রেলওয়ে ম্যানেজার সীতাংশ চক্রবর্তী জানান, তৃতীয় দিন যাত্রায় বেশ কয়েকটি ট্রেন বিলম্বে চলাচল করছে। মূলত এসব ট্রেন বিলম্বেই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসছে। স্টেশনে ট্রেন পৌঁছামাত্রই ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন যাত্রীরা।

এদিকে রেলের সেবাসহ সার্বিক বিষয়ে পরিদর্শনে বুধবার কমলাপুরে যান রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। এ সময়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেলের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চান রেলওয়ে আমূল পরিবর্তন। সিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়েই কিছু কিছু ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে।

সদরঘাটে : এবার লঞ্চের টিকিট নিয়ে খুব বেশি হৈচৈ নেই ঘরমুখো মানুষদের। তবে কেবিন সংকট চরমে। লঞ্চে তিন ধরনের টিকিট থাকে। ডেক, সোফা এবং কেবিন। ডেকের জন্য আগে কোনো টিকিট কাটতে হয় না। এরা লঞ্চের ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে যায়। আর সোফার জন্য এবং কেবিনের জন্য আগে বুকিং দিতে হয়। আবার কেবিনও দুই ধরনের। নরমাল এবং ভিআইপি। বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে জানা যায়, এক সপ্তাহ আগেই সব লঞ্চের ভিআইপি টিকিট শেষ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রভাবশালী মহল এসব টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছেন।

কোনো তদবির ছাড়া সহজে নরমাল কেবিনও মিলছে না। তবে সোফার টিকিট লঞ্চঘাটেও বিক্রি হচ্ছে। বুধবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর থেকেই যাত্রীদের চাপ। তবে সাধারণ যাত্রীদের টিকিট নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। সকালে এসেই সোফার টিকিট কেটে লঞ্চে যাত্রা করেছেন অনেকে। বিকালে লাইনে টিকিট কেটে নির্ধারিত লঞ্চেই বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা। অনেক যাত্রী অগ্রিম টিকিট কাটতেও সদরঘাটে এসেছেন। বরিশালগামী সরকারি চাকরিজীবী আবদুল বাতেন জানান, প্রথম শ্রেণীর টিকিট না পেয়ে লাইনে কম সময়েই সাধারণ টিকিট পেয়েছি। যাত্রীদের চাপও কম। মনে হচ্ছে, ঠিক সময়েই বাড়ি পৌঁছানো যাবে।

এদিকে ঈদযাত্রায় নৌপথে যাত্রী ভোগান্তি এড়াতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ। ইতিমধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও ঢাকা জেলা প্রশাসন কয়েক দফায় বৈঠক করেছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ জানায়, ঈদযাত্রায় বিশেষ করে মঙ্গলবার, বুধবার নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ ছেড়েছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রুটিন মেনেই লঞ্চ ছাড়বে।

সিডিউল বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত লঞ্চ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিডিউলের বাইরেও কিছু লঞ্চ সদরঘাট ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে যাত্রা করবে। এজন্য যাত্রীদের নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা আগে টার্মিনালে আসার নির্দেশনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এবার ঈদ যাত্রার বহরে যুক্ত হয়েছে কীর্ত্তনখোলা-১০, অ্যাডভেঞ্চার-৫ ও ৯ নামের নতুন ৩টি অভিজাত লঞ্চ। এসব লঞ্চেরও প্রথম শ্রেণীর টিকিট নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে। এ নিয়ে টার্মিনালে অনেক যাত্রীকে ক্ষুব্ধ মনোভাব ব্যক্ত করতে দেখা গেছে।

গাবতলীতে উল্টো চিত্র : অন্যান্য ঈদের সময় যে চিত্র থাকে তার প্রায় উল্টো চিত্র বিরাজ করছে রাজধানীর আন্তঃনগর বাস টার্মিনাল গাবতলীতে। অর্থাৎ বাসের কাউন্টারগুলোতে তেমন ভিড় নেই। যাত্রীদের জন্য টিকিটের টানাটানি প্রায় নেই বললেই চলে। বরং যাত্রী সংকটে ভুগছে স্বল্পপাল্লার অনেক বাস। দূরপাল্লার ক্ষেত্রে যারা আগেই টিকিট কেটেছেন তারা ছাড়া বাড়তি যাত্রীর চাপ কম।

বাস কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিক সময়েই বাস ছেড়ে যাচ্ছে। দুর্ভোগ নেই বললেই চলে। যাত্রীর অবস্থা দেখে ঈদের বাজার মনেই হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকারি ছুটি কম হওয়ায় চাকরিজীবীরা এই ঈদে বাড়ি যাচ্ছে না। তাছাড়া যারা যাবেন তারা তাদের পরিবার-পরিজনদের আগেই পাঠিয়েছেন। উপস্থিত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাবতলী টার্মিনালে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা সন্তুষ্ট। তেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না।

এদিকে যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিকর বলে দাবি করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বুধবার সকালে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশের রাস্তার অবস্থা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক ভালো। কারণ দুর্ভোগ কমানোর জন্য এ বছর আগে থেকেই বিশেষ নজরদারি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, বাস মালিকরাও বলছেন, রাস্তা ভালো, যানজট নেই। যাত্রীদের কাছে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়নি। এ ধরনের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, উত্তরাঞ্চলে যাতায়াতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn