২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি নির্বাচনে কারাবন্দি থেকেই মেয়র নির্বচিত হন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। বিরোধী নানা সমালোচনা সত্ত্বেও সে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। কেনো কামরান এতো জনপ্রিয়- ওই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিলো সেবার কামরানের নির্বাচন পরিচালানা কমিটির সদস্য সচিব প্রয়াত সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরুকে। জবাবে শীরু বলেছিলেন- কামরানকে কেউ আগে সালাম দিতে পারে না। তিনিই সবাইকে আগে সালাম দেন। সিলেটের লোকজন রাস্তাঘাটের উন্নয়নের চাইতে ভালো ব্যবহার ও সম্মান চান। কামরান সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করেন ও সবাইকে দেখান। একারণে সিলেটবাসীও তাকে পছন্দ করেন।  ততোটা উন্নয়মুখী নন এমন অভিযোগ সত্ত্বেও সবার সাথে সুসম্পর্কেও কারণে টানা প্রায় ১৭ বছর সিলেট সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন কামরান।
‘এই শহরের প্রিয় নাম, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান’- নিজের সমর্থকরা তাঁর পক্ষে এমন স্লোগানও দিয়ে থাকেন। সিলেট শহরের এই ‘প্রিয় নামটি’ হেরে যান গত নির্বাচনে। বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে প্রায় ৩১ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান কামরান। সে নির্বাচনে কামরানের পরাজয়ের পেছনে অনেকগুলো কারণে দলের ভেতরের বিভেদ ও তাঁর মেয়াদকালে কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়াকে দায়ী করেন অনেকে। এ ব্যাপারে সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কীম বলেন, কামরান দীর্ঘসময়ে নগর ভবনের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই সময়ে নগরীর কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ফলৈ গত নির্বাচনে জনতার রায় তাঁর পক্ষে যায় নি। গত নির্বাচনে দলের অনেক নেতাই কামরানের পক্ষে কাজ করেননি বলে অভিযোগ ওঠে। ভোটের পরিসংখ্যানেও এর সত্যতা মিলে।  ২০১৩ সালে সিলেট সিটিতে মোট ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৯১ হাজার ৪৭ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৩৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পান ৭২ হাজার ১৭৩ ভোট। দু’জনের ভোটের ব্যবধান ছিলো ৩১ হাজার ১৫৭ ভোটের। তবে গত নির্বাচনে ১ লাখ ১০ হাজার ৫২২ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগই করেননি। বলা হয়ে থাকে, ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া এসব ভোটারদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও কামরানের ভোটার।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, গত নির্বাচনে দলের অনেক নেতা কামরানের বিরুদ্ধে থাকায় তাদের অনুসারীরা সেবার ভোট দিতে যাননি। এছাড়া কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ায় কামরানের নিজস্ব ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও গত নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে কামরানের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিভিন্ন কেন্দ্রে নিজেদের অনুসারীদের এজেন্ট করলেও কামরানের সাথে দুরত্ব থাকায় ভোটের দিন তাদের কেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখেন। কামরানের সাথে সিলেট-১ আসনের সাংসদ ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দুরত্ব দীর্ঘদিনের। এই দুরত্বের সুযোগে গত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়ে বিএনপি দলীয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরী সখ্যতা গড়ে তুলেন অর্থমন্ত্রীর সাথে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজের সাথেও কামরানের বিরোধীতা রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া এবার কামরানের সাথে আওয়ামী লীগ থেকে পাঁচ নেতা মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দাবি করেন। দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন মেয়র প্রার্থী হতে দীর্ঘদিন থেকেই মাঠে সক্রিয় ছিলেন।দলের ভেতরের এই দুরত্ব বিভেদগুলো কী এবার ঘোচাতে পারবেন কামরান? এক্ষেত্রে কামরান যতোটা সফল হবেন নির্বাচনের মাঠে ততোই এগোবেন মহানগর আওয়ামী লীগের এই সভাপতি। কাঙ্খিত উন্নয়ন না করার অভিযোগ, দলের কয়েকজন নেতাদের সাথে দুরত্বের কারণে প্রকাশে আওয়ামী লীগ তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামলেও স্বস্থিতে নেই বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। শেষ সময়ে বিএনপির বিরোধ মিটিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিমের আরিফকে সমর্থন জানানো এই অস্বস্থি আরও বাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে বিভিন্ন মতভেদ থাকতে পারে। অনেকে প্রার্থী হতে চাইতে পারেন। কিন্তু কোনো বিভক্তি নেই। সিলেট আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত। ৩০ তারিখের নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।  কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে কামরান বলেন, আমি কসমেটিক উন্নয়নে বিশ্বাসী নই। নগরীর উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণসহ আমি বেশকিছু বড় প্রকল্প গ্রহণ করি। পরবর্তী মেয়র তা এগিয়ে নিতে পারেননি। এবার অবশ্য শুরু থেকেই দুরত্ব ঘোচানোর উদ্যোগ নেন কামরান। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিও এতে উদ্যোগী হয়। দলীয় মনোনয়ন কেনার আগেই কামরান ছুটে যান অর্থমন্ত্রীর ঢাকার বাসায়। দলের প্রবীন এই নেতার ‘দোয়া’ নিয়েই দলীয় মনোনয়ন কেনেন কামরান। দল থেকেও আবার কামরানের উপরই ভরসা রাখা হয়। আরও চার প্রতিদ্বন্দ্বি থাকা সত্ত্বেও কামরানই দলীয় মনোনয়ন পান।
জানা যায়, কামরানকে মনোনয়ন দেওয়ার পর খোদ দলীয় সভানেত্রী সিলেটের সকল নেতাদের ঐক্যবদ্ধ মাঠে নামার নির্দেশ দেন। যেকেনো মেয়র পদ পুণরুদ্ধারেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনার পর বিভেদ ভুলে প্রকাশ্যে এখন পর্যন্ত কামরানের পক্ষেই মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগে সব নেতা। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, গত নির্বাচনেও প্রকাশ্যে কামরানের পক্ষে ছিলেন আওয়ামী লীগের সব নেতা। কিন্তু ভোটের দিন দেখা গেছে তাদেও অনুসারীরা ভোট কেন্দ্রে যায় নি। এজেন্টের দায়িত্ব নিয়েও তা পালন করেনি। এর প্রভাব পড়েছে নির্বাচনের ফলাফলে। এবার এখন পর্যন্ত সব নেতা ঐক্যবদ্ধভাবেই কামরানের পক্ষে থ্কালেও তারা কতটুকু আন্তরিকভাবে আছেন তা বোঝা যাবে ভোটের দিন। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদউদ্দিন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ এবার অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। দলের সভানেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন আমরা তার পক্ষে রয়েছি। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দেও সুযোগ নেই। দলের সভানেত্রীর নির্দেশে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কামরানের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তবে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদের দাবি আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হলেও এবার কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, কামরান সালাম দিয়ে ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ১৭ কাটিয়ে দিয়েছেন। কোনো উন্নয়ন করেননি। অথচ আরিফুল হক মাত্র দুই বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। এই দুই বছরে তিনি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উন্নয়ন করেছেন। ফলে এবার ভোটাররা যোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn