আবু সালেহ আকন:

ভাগ্যবানদের মধ্যে আরেকজন হলেন হুমাম কাদের চৌধুরী। সবাই তাদের ভাগ্যবানই মনে করছেন। নিখোঁজ হলেও অন্তত তারা ফিরে এসেছেন। স্বজনেরা তাদের ফিরে পেয়েছেন। ফিরে এলেও কারা তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল, কোথায় রেখেছিল সে রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে না। সব কিছুর পরেও তাদেরকে ফিরে পেয়ে খুশি পরিবারপরিজন। এখনো অনেকেই রয়েছেন যারা বছরের পর বছর নিখোঁজ। তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে পরিবাগুলোর পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা চাইলেও কোনো অগ্রগতি নেই। অনেকের পরিবার এখন শুধু লাশটি ফেরত চায়। আর অনেকে তো লাশ ফেরত পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ফিরে এসেছেন তারা ভয়ে চুপচাপ থাকলেও পরিবারগুলোতে এখন স্বস্তি আছে। এরমধ্যে সর্বশেষ যিনি ফেরত এসেছেন তিনি হলেন বিএনপি নেতা হুমাম কাদের চৌধুরী। গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে তুলে নেয়া হয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরীকে। একটি মামলায় তিনি এবং তার মা আদালতে গিয়েছিলেন হাজিরা দিতে। সেখানে গাড়ি থেকে নামার পরেই সাদা পোশাকধারীরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়েছিল বলে ওই সময় অভিযোগ করেন হুমামের আইনজীবীরা। সে সময় থেকেই নিখোঁজ ছিলেন হুমাম কাদের চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে তিনি ফিরে এসেছেন। কে বা কারা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেলে সেখান থেকে তিনি বাসায় ফেরেন।
২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিলের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের দেলপাড়া এলাকার ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশন এলাকা থেকে অপহৃত হন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক। ওই বছরের ১৮ এপ্রিল মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় কে বা কারা তাকে ছেড়ে দিয়ে যায়। এই ঘটনায় আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা করলেও কে বা কারা আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করেছিল সে সম্পর্কে কোনো রহস্য আজো উদ্ঘাটন হয়নি।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ একদল অচেনা লোক উত্তরার ভাড়াবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বিএনপির তৎকালীন মুখপাত্র সালাহ উদ্দিনকে। প্রায় দুই মাস পরে ভারতের শিলং থেকে উদ্ধার করা হয় সালাহ উদ্দিনকে। কে বা কারা সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই রহস্য আজো বের হয়নি।
গত ১৬ মার্চ নিখোঁজ হন আইটি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় তিনি তদন্তসংশ্লিষ্টদের সহায়তা করে আসছিলেন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পরে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। কয়েক দিন পরে বিমানবন্দর এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যান।
ওই পরিবারগুলো খুশি তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পেয়ে। কিন্তু অনেক মানুষ নিখোঁজের পর তাদের কোনো হদিসই মিলছে না। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর; এভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, কিন্তু প্রতীক্ষার পালা শেষ হয় না ওই পরিবারগুলোর।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে অপহৃত হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। তার গাড়িচালক আনসার আলীকেও তুলে নেয়া হয়। এ ঘটনায় ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদি বনানী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করে। ঘটনার পর তাহসিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকের সাথেই সাক্ষাৎ করে তার স্বামীকে উদ্ধারের দাবি জানান। কিন্তু চার বছরেও ইলিয়াস আলী উদ্ধার হননি।
২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে অপহৃত হন বিএনপি নেতা ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম। ২৫ জুন রাত ৮টায় ফার্মগেটের বাসায় যাওয়ার পথে তার গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়। এরপর থেকে তার কোনো হদিস নেই। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি লাকসাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ, রাজধানীর দক্ষিণখানের ছাত্রদল নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্না (২৪), ঝিন্টু (২৪), কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান সেন্টু, বংশাল থানার সহসভাপতি সোহেল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো: জহির ও সাধারণ সম্পাদক মো: পারভেজ, ৭২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহসভাপতি ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সদস্য সাব্বির, বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: চঞ্চল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য মো: কালু, সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আনিসুর রহমান ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো: বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মিঠুকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাযহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিয়াউর রহমান, গোপালগঞ্জের বোড়াশী পশ্চিমপাড়ার মান্দারতলা এলাকার উবায়দুর, কাশিয়ানি উপজেলার দক্ষিণ ফুকরার মিল্টন বাজার এলাকার মাহবুব, আওয়ামী লীগ নেতা নুর মোহাম্মদ হাজী, তার জামাতা নজরুল ইসলাম বাছা, ব্যবসায়ী হুমায়ুন, কামরাঙ্গীরচরের মাওলানা শামীম, ওয়ালি উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আবদুল করিম হাওলাদার, রাজধানীর মিরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালাম শেখ, তার মামাতো ভাই আবুল বাশার শেখ, আবদুল করিম ও আতাউর রহমান ওরফে ইস্রাফিল, পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসায়ী রেজাউল করিম রিজভি, সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী তারিব উদ্দিন আহম্মেদ, শাহজাহানপুর থেকে দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলাম, জিন্দাবাহার লেন এলাকার ব্যবসায়ী আয়নাল মোল্লা, কামরাঙ্গীরচরের আবদুল আজিজ লেনের বাসিন্দা সুলতান হাওলাদার, রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, ফকিরেরপুলের হোটেল অবসরের সামনে থেকে ফেনীর সারোয়ার জাহান বাবুল, রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে ব্যবসায়ী মমিন হোসেন, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপা জামে মসজিদের ইমাম ও গোদাগাড়ী পালপুর ধরমপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম, মালিবাগ থেকে অপহৃত ভোলার আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, আকাশ ও মিরাজ, হাতিরপুল এলাকা থেকে নিখোঁজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, মাসুম হোসেন, ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তাবির উদ্দিন আহম্মেদ রানা। রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে নিখোঁজ হন তপন দাস। আরো নিখোঁজ হন ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তুষার ইসলাম টিটু, ফার্মগেটের ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, ব্যবসায়ী জহির রায়হান হিরণ, ব্যবসায়ী হাজী ওয়াজি উল্লাহ, সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ের ইউনুস মুন্সি, তার মামাতো ভাই শেখেন মাতবর, তাদের সঙ্গী হাফিজুল ইসলাম স্বপন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার মোজাফফর, ব্যবসায়ী শহীদুর রহমান, সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: মাসুদ, যাত্রাবাড়ীর গোলাম মুর্তাজা, বরিশালের করিম কুঠির এলাকার আলী হায়দার, বরিশালের জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা নান্না, ফরিদপুরের নগরকান্দার সোবহান এবং গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস (২৩) ও ওয়ালিউল্লাহ (২৪), ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার এবং তার দুই সহযোগী মুরাদ ও ফোরকান, মিজানের শ্যালক মিজান শিকদার এবং তার ভাতিজা সুমন, নজরুল ইসলাম বাছা, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আবদুল করিম হাওলাদার। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ পল্লবী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলাম। এভাবে আরো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন দিনের পর দিন। তাদের পরিবারগুলো বছরের পর বছর প্রতীক্ষায় রয়েছে স্বজনের ফিরে আসার।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn