শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি : অনলাইনে ফল

এই তো বৃহস্পতিবার ২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ ফলের জন্য এখন আর কারও কলেজের বারান্দায় গিয়ে লাইন ধরতে হয় না বা হুড়াহুড়ি করে নোটিশ বোর্ডে দেখতে হয় না। এখন মোবাইল ফোন থেকে রোল নম্বর, বোর্ডের নাম বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর এসএমএস করলে মুহূর্তেই ফিরতি এসএমএসে জানিয়ে দেয়া হয় ফল। অথবা বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ফলের লিঙ্কে ক্লিক করে রোল নম্বর দিলেই পেয়ে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত ফল।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি : অনলাইনে ফরম পূরণ

একসময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের অনেক দূর থেকে দেশের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসে, ট্রেনে যেতে হতো, লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তির ফরম নিয়ে সেই ফরম পূরণ করে আবার তাদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্যাশ টাকা ও ফরম জমা দিয়ে পরীক্ষার প্রবেশপত্র নিতে হতো। ২০০৯ সালে শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করল তারা পুরো প্রক্রিয়াটি তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে শেষ করবে এবং এই ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো কাগজ ব্যবহার হবে না! ভর্তির রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোনো প্রার্থীকে তার ঘর থেকেই বের হতে হবে না। কাগজবিহীন ডিজিটাল এ ভর্তি প্রক্রিয়াটি ২০০৯ সালের ২১ আগস্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন এবং তারপর থেকে এ দেশের প্রায় সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সময় এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ হয়ে গেল পানির মতো সহজ।

কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি : কাগজবিহীন অফিস

১৯৭৫ সালে বিজনেস উইক নামের এক ম্যাগাজিনে প্রথমবার কাগজ ব্যবহার না করে অফিসের কাজকর্ম করার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল; কিন্তু তখন সেটি ছিল অনেকটা কল্পবিজ্ঞানের মতো। কারণ এটি বাস্তবে রূপ দিতে হলে অফিসের সবার কাছে একটা কম্পিউটার থাকতে হবে, যেটি তখন কেউ চিন্তাও করতে পারত না। এখন অনেক অফিস পুরোপুরি কাগজবিহীন অফিসে পাল্টে গেছে। অফিসে কাগজে কিছু লিখতে হয় না, কম্পিউটারে লিখে একজন আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কম্পিউটারগুলো নেটওয়ার্ক দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে আছে। কাজেই চোখের পলকে সব কাজকর্ম হয়ে যায়। কাগজে কিছু লেখা হয় না বলে কাগজের খরচ বেঁচে যায়। কাগজ তৈরি হয় গাছ থেকে তাই যখন কাগজ বেঁচে যায় তখন গাছও বেঁচে যায়। কাগজে লেখায় কালি টোনার ব্যবহার হয় না বলে রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পরিবেশও দূষণ হয় না।

কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি : ভার্চুয়াল অফিস

বরতমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়ে প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকি কম্পিউটার দিয়ে, আর সব কম্পিউটারই যদি নেটওয়ার্ক দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে দেয়া থাকে, তাহলে আমি সেই কম্পিউটারটি অফিসে বসে ব্যবহার করছি নাকি বাসায় বসে ব্যবহার করছি, তাতে কী আসে যায়? আসলেই কিছু আসে যায় না, আর সেটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের অফিসের ধারণা। মূলত যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করে থাকে, তারাই এ ভার্চুয়াল অফিসের সুবিধা পেয়ে থাকেন। ১৯৮৩ সালে প্রথম এটা নিয়ে আলোচনা হয় আর ১৯৯৪ সালে প্রথম এ ধরনের একটা অফিস তার কাজ শুরু করে। যারা কাজ করছে তারা সশরীরে কেউ অফিসে নেই কিন্তু অফিসের কাজ চলছে এরকম অফিসের নাম হচ্ছে ভার্চুয়াল অফিস।

নির্বাচনে প্রযুক্তি : ইভিএম

একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকার থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই ঠিক করা হয় নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে। ভোট দেয়ার জন্য দরকার ব্যালট পেপার অর্থাৎ কাগজ, যেখানে প্রার্থীদের নাম এবং মার্কা ছাপা থাকে। ভোটারদের সেখানে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলতে হয়। নির্বাচন শেষে সেগুলো গুনতে হয়। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে এরকম কোনো সমস্যা নেই। ভোটাররা সরাসরি মেশিনের বোতাম চেপে ভোট দেয় এবং নির্বাচনের সময় শেষ হলে মুহূর্তের মধ্যে ফল বের হয়ে যায়। আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম দিয়ে পরিচালনা করা হয়েছে।

সমাজ জীবনে প্রযুক্তি

একসময় যোগাযোগ বলতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে এক দেশ থেকে আরেক দেশে দূত পাঠিয়ে খবর দিতে হতো। মানুষ লিখতে শেখার পর চিঠি লিখে মনের ভাব আর খবর পাঠাতে শুরু করল। গড়ে উঠল ডাক বিভাগ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চিঠি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা। টেলিগ্রাফ আর টেলিফোনের আবিষ্কার এই চিঠি আদান-প্রদান আরও সহজ করে ফেলল। আর এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সামাজিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারগুলোকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোন, এসএমএসে এখন মনের সব কথা পৌঁছে যায় মুহূর্তেই শতসহস্র মাইল দূরে। আর স্মার্টফোন যোগ করেছে এই সেক্টরে নতুন মাত্রা। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ সামাজিক এ মাধ্যমগুলো আরও সহজে কাছে যেতে সাহায্য করে মানুষকে। প্রযুক্তি জীবনের এতটাই কাছাকাছি যে, এখন চাইলেই আপনি কখন পানি খাবেন, কখন ওষুধ খাবেন, প্রতিদিন কতক্ষণ হাঁটবেন, ঘড়িতে কয়টা বাজে, কখন আপনার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে, কোন খাবার কতটুকু খাবেন অথবা বাসায় বসেই ইয়োগা কীভাবে করবেন তা মোবাইল অ্যাপ থেকেই জানতে পারবেন খুব সহজেই। এমন কিছু অ্যাপের বিস্তারিত-

হোম ওয়ার্কআউট

মূলত বাসায় বা কার্যক্ষেত্রে বসেও যেন মানুষ তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারে সেভাবেই অ্যাপ্লিকেশনটির ডিজাইন করা হয়। এক কোটিরও বেশি মানুষ নিত্যদিন ব্যবহার করছে অ্যাপ্লিকেশনটি। ২০টিরও বেশি ধাপ ছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্কআউট চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে নিজের সাস্থ্য ভালো রাখা এবং বডি বিল্ডিং করা যায়।

লাইফসাম

সময়মতো পানি খেতে মনে থাকে না, তৃষ্ণায় ছটফট না করা পর্যন্ত আপনি পানি পান করতে ভুলে যান তবে লাইফসাম নামের অ্যাপটি আপনার জন্য। কারণ এ অ্যাপটি আপনাকে পানি খাবার সময় মনে করিয়ে দেবে, সঙ্গে সঙ্গে যে লক্ষ্যটি আপনি ঠিক করেছেন সেটা পূরণ করতেও সাহায্য করবে ভালোভাবেই।

টনিক

টনিকে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে আপনি তাদের ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ পেতে পারবেন যে কোনো সময়। তা ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছাড় পাওয়া যায় বছরের সবসময়ই।

মেডিকেয়ার হেলথ

কর্মব্যস্ততায় প্রায়ই ওসুধ সেবনের কথা ভুলে যান। আপনাকে সময়মতো ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দেবে এই অ্যাপ্লিকেশনটি। তা ছাড়া দূরবোধ্য ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র পড়তেও সহায়তা করবে এ অ্যাপটি।

ফুডুকেট

ফুডুকেট এ অ্যাপটি স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং ওজন সঠিকভাবে রক্ষা করতে সাহায্য করে। প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজারের ওপর খাদ্যের পুষ্টিগুণ দেয়া আছে, সঙ্গে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী খাদ্য গ্রহণের পরামর্শও। আপনার ঘুম, মেজাজ ও ক্ষুধার খবরও রাখবে এবং এখানেই আপনি আপনার পছন্দের খাবারের তালিকা রাখতে পারবেন।

কথা বলা ঘড়ি

মানুষের জীবনে মহামূল্যবান বিষয় ‘সময়’ ব্যস্ততার ভিড়ে বা কাজে মগ্ন হয়ে ভুলে যান সময় দেখতে। এখন ১১টা বেজে ৩০ মিনিট আর আপনাকে ৩টার মধ্যে হাতের কাজ শেষ করতে হবে কেননা ৩টায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং কল করেছেন কিন্তু কাজের চাপে আপনি ভুলেই গেছেন কখন ৪টা বেজে গেছে। তবে এ কথা বলা ঘড়িটি আপনার জন্য। এটি আপনাকে প্রতি ১৫ মিনিট পর অবহিত করবে সময় জানিয়ে।

দিনের সব কাজের তালিকা রাখবে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট

সম্প্রতি সারা দিনের রুটিন একসঙ্গে স্ক্রল করে দেখার ফিচার যুক্ত করছে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টে। যেমন ক্যালেন্ডার, শেয়ার মার্কেট, ফ্লাইটের সময়, রেস্টুরেন্ট বুক করা, মিটিংয়ের সময়, পণ্য ডেলিভারি নেয়ার সময় ও রিমাইন্ডার সব কিছুই এখন ‘ভিজুয়াল স্ন্যাপশটে’ । আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড দুই ভার্সনেই এ সুবিধা দেবে গুগল। এছাড়া ব্যবহারকারীর পছন্দ হতে পারে এমন ইউটিউব ভিডিওর সাজেশনও দেখাবে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভ্রমণ করার জন্য কয়টায় বের হওয়া প্রয়োজন তাও জানাবে অ্যাপটি। এ প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বিপ্লবের প্রভাব হবে ব্যাপক। ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণেও ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তি বিপ্লব সরকারি সেবাকে একদিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসবে, অন্যদিকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সহজলভ্যতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকিও বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিরাপত্তা ঝুঁকির এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে, সেই আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn