প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কারিকুলাম বা পাঠক্রমে আসছে বড় পরিবর্তন। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে এ পরিবর্তন আনা হবে। এ বিষয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করা হয়েছে। পাঠক্রম পরিবর্তিত হলেও বিষয় বা বইয়ের সংখ্যা কমানো হবে না। মূলত কারিকুলামের চাহিদা অনুযায়ীই নিরূপণ করা হবে বইয়ের সংখ্যা। তবে প্রতিটি বিষয়ের সিলেবাসের (পাঠ্যসূচি) ব্যাপ্তি কমিয়ে আনা হবে। নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী বিষয়সংখ্যা কমানোর সম্ভাবনা খুবই কম। পাঠক্রম পরিবর্তনের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বিভাগ এবং মাদরাসা বোর্ড আলাদাভাবে কাজ করছে। এনসিটিবি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, ২০২১ সালে প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী বই পাবে। ২০২২ সালে পাবে তৃতীয়, চতুর্থ, সপ্তম, নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ২০২৩ সালে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষার্থীরা নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী বই পাবে। ওই বছর থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হবে নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী। ২০২৪ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হবে নতুন পাঠক্রমে। আর ২০২১ সাল থেকে মাদরাসার পাঠক্রমে পরিবর্তন আসছে। সব পাঠক্রমেই ২০১২ সালে সর্বশেষ পরিবর্তন এনেছিল এনসিটিবি। পাঁচ বছর পর পর পাঠক্রমে পরিবর্তন আনার নিয়ম থাকলেও এবার পরিবর্তন আসছে ৯ বছর পর।
জানা যায়, একই সঙ্গে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা দুই বছর মেয়াদি করার বিষয়েও কাজ চলছে। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির আগে সরকারি স্কুলে একটি শ্রেণি আছে। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে প্রথম শ্রেণির আগে সরকারি স্কুলেও দুটি শ্রেণি পড়তে হবে শিশুদের। আর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রেখে ধারাবাহিক মূল্যায়নের লক্ষ্যেও কাজ চলছে। এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, পাঠক্রম পরিবর্তনে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে এনসিটিবি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০৩০ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-৪-এর লক্ষ্য অর্জন, উন্নত দেশে পরিণত হতে রূপকল্প-২০৪১ অর্জন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কারিকুলামের সংগতি।
সূত্র মতে, কয়েকটি ধাপে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কাজ চলছে। প্রথম ধাপে শিক্ষাক্রমের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা বের করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে এখন বিশেষজ্ঞরা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা খুঁজে বের করছেন। এরপর একাধিক কর্মশালা ও গবেষণা শেষে নতুন পাঠক্রম তৈরি করা হবে। এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, পাঠক্রম পরিবর্তনে বেশ কিছু বিষয়কে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। প্রথমত দেখা হচ্ছে, বিদ্যমান কারিকুলাম কতটা ইফেক্টিভ। এরপর জাতীয় পরিস্থিত ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের ধারা বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশীয় পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, এসডিজি-৪ অর্জন, উন্নত দেশে যাওয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান, শিক্ষানীতি ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। আর বৈশ্বিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক কারিকুলাম, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে।
রিয়াজুল হাসান আরও বলেন, আমরা এমন ধরনের কারিকুলাম তৈরি করতে চাই, যার ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থী যে চাকরি করবে, তা এখনো বাংলাদেশের বাজারে আসেনি। কারণ আজ যে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে, সে হয়তো আরো ১৫-১৬ বছর পর চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। তাই তখন চাকরির বাজারে কী ধরনের চাহিদা থাকবে, তা বিবেচনায় নিয়েই আমরা পাঠক্রমে পরিবর্তন আনব। তবে বইয়ের বোঝা যতটা কমানো যায়, সে ব্যাপারটাও আমাদের চিন্তায় আছে। কিন্তু বেসিক ফাউন্ডেশন ঠিক রাখতে হবে। তাই কারিকুলামের চাহিদা অনুযায়ীই বইয়ের সংখ্যা নিরূপিত হবে। বর্তমানে এনসিটিবির পাঠক্রম অনুযায়ী, প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনটি করে পাঠ্য বই এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টি করে পাঠ্য বই পড়তে হয়। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩টি পাঠ্য বই পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। নবম-দশম শ্রেণিতে ২৭টি এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩৯টি পাঠ্য বই আছে। যদিও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভাগ হওয়ায় নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ের বই পড়তে হয় না। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মাদরাসার ধর্মীয় চারটি বিষয় কোরআন, আকাইদ ও ফিকাহ, হাদিস এবং আরবির পাঠক্রমেই মূলত পরিবর্তন আসছে। কোরআনের বিভিন্ন সুরা একবারে নাজিল হয়নি, ধাপে ধাপে নাজিল হয়েছে। কোনো সুরা দীর্ঘ সময় নিয়ে নাজিল হয়েছে। এসব সুরা নির্দিষ্ট কোনো বয়সের জন্য নির্ধারিত নয়। পুরো সুরা একটি শ্রেণির জন্য পাঠ্য করায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়ে। তাই পাঠক্রম পরিবর্তনে এই বিষয়গুলো বিচেনায় রাখা হবে।
সূত্র মতে, মাদরাসার বইয়ে বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়—এমন কিছু যেন না থাকে পাঠ্য বইয়ে, সেদিকে নজর রাখা হবে। জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ বা এমন কোনো আলোচনার সূত্র, জিহাদের অপব্যাখ্যা না রাখার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে তরুণ সমাজের অবদান, নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি বন্ধ করা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হবে। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ কে এম ছায়েফ উল্যা বলেন, মাদরাসার কারিকুলাম উন্নয়নে সব বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করা হবে। এরই মধ্যে আমাদের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ করতে পারব বলে আশা করি। তিনি আরও বলেন, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এখন আর কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই। তারা সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের চেয়ে চারটি বিষয় বেশি পড়ছে। মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করছে। নতুন পাঠক্রমে তাদের আরো যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১২০ বার