গত শুক্রবার দুটো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ভারতের রাজস্থানে। রাকবার খান নামে এক গরিব মুসলমানকে হিন্দু গোরক্ষকরা মেরে ফেলেছে। রাকবার খান গরু কিনে বাড়ি ফিরছিল। গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালাত রাকবার। গোরক্ষকরা এ পর্যন্ত কম মুসলমানকে গোমাংস খাওয়ার অথবা গরু পাচার করার অভিযোগে হত্যা করেনি। পেহলু খান, তালিম হুসেন, আহমদ খান, এরকম অনেকে গোরক্ষকদের শিকার হয়েছে। গোরক্ষকদের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচণ্ড বেড়েছে ভারতে গোমাংস নিষিদ্ধ হওয়ার পর। ভারত কিন্তু বিশ্বের বাজারে গোমাংস রপ্তানি করার সবচেয়ে বড় দেশ ছিল। গরু রক্ষার আইন জারি হওয়ার পর, রমরমে রপ্তানি ব্যবসা পথে বসেছে। হাজারো লোক চাকরি হারিয়েছে। মোষের মাংসই এখন ‘বিফ’ হিসেবে রপ্তানি হয় বটে, কিন্তু এ কারণে অশান্তি কম নয়। গবাদি পশুর ব্যবসায়ীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। মোষের ট্রাক থামিয়েও গোরক্ষকরা কিছু মোষের ব্যবসায়ীকে গরু পাচারকারী হিসেবে সন্দেহ করে খুন করেছে।
ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে গোমাংস নিষিদ্ধ করার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তরে উদারপন্থিরা বলেন, ছিল না। আর হিন্দু কট্টরপন্থিরা বলেন, ছিল। অনেকে মনে করেন, গোমাংস নিষিদ্ধকরণের পেছনে ধর্মীয় কারণের চেয়ে রাজনৈতিক কারণই বড়। একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ কী খাবে না খাবে, কী পরবে না পরবে তা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। যারা গরুকে দেবতা মানে, তারা গোমাংস খাবে না। যারা মানে না তারা খাবে। এ-ই তো হওয়া উচিত। নিরামিষাশীর সংখ্যা বেশি বলে কি মাছ-মাংস বিদেয় করে দিতে হবে বাজার থেকে? অথবা মাংসাশী লোক প্রচুর বলে কি শাক-সবজি নিষিদ্ধ করতে হবে? গোমাংস ভক্ষণে অনেকের আপত্তি, তাই বলে গোমাংস নিষিদ্ধ করতে হবে কেন। অল্প কিছু লোকের যদি গোমাংস পছন্দ হয়, তবে গোমাংস খাওয়ার অধিকার তাদের থাকবে না কেন। একটি গণতন্ত্রে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়, সংখ্যালঘুরও স্বার্থ দেখতে হয়। গোমাংসের ব্যবসা নষ্ট হলেও ফুলে ফেঁপে উঠেছে গোমূত্রের ব্যবসা। আজকাল গোদুগ্ধের চেয়ে গোমূত্রের মূল্য বেশি। কুসংস্কার চিরকালই বিক্রি হয়েছে, আজও হয়। মানুষের মূর্খতাকে সম্বল করে কোটিপতি হয় নানা কিসিমের ‘বাবা’। ওদিকে গো-হত্যা বন্ধ হওয়ায় গরুর সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, রাস্তা-ঘাটে অসহায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পঞ্চাশ লক্ষ গরু। যেসব গরু হাল চাষের অযোগ্য হয়ে গেছে, সেসব গরুকে বাজারে বিক্রি করে দিয়ে চাষিরা ঘরে টাকা আনতো। সেই দিন আর নেই। এখন গরুর পাল অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। অভাব ঢুকছে চাষিদের ঘরে।

রাজস্থানের কথা হচ্ছিল। এই রাজস্থানেই তো পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা শ্রমিক আফরাজুলকে কুপিয়ে আর পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল এক কট্টরবাদী রাজস্থানী হিন্দু। আফরাজুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আফরাজুল না করলেও আফরাজুলের মতো মুসলমানরা হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করছে, হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে বিয়ে করছে, বিয়ে করে জোর করে তাদের মুসলমান বানাচ্ছে। এভাবেই প্রেমের জিহাদ চালাচ্ছে মুসলমানরা। জিহাদ চালিয়ে নব্য মুসলমানের সংখ্যা হয়তো বাড়াচ্ছে কেউ কেউ, কিন্তু সবাই তা করছে বলে আমি মনে করি না। অনেক মুসলমানই হিন্দুর প্রেমে সত্যিকার পড়েছে, বিয়ে করার পেছনে কোনও বদ উদ্দেশ্য নেই। হিন্দু আর মুসলমান এক দেশে এক সমাজে বাস করছে, এক কলেজে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, এক অফিসে চাকরি করছে, এক থিয়েটারে নাটক সিনেমা দেখছে, পরস্পরের জন্য তাদের কারওই একেবারেই কোনও আকর্ষণ তৈরি না হওয়াটা অস্বাভাবিক।

গতকাল গাজিয়াবাদে এক মুসলমান যুবক তার হিন্দু প্রেমিকাকে নিয়ে কোর্টে গিয়েছিল বিয়ে করবে বলে। খবর পেয়ে আদালত চত্বরেই যুবকটিকে তুমুল পিটিয়েছে এক দল হিন্দু। পুলিশ এসে যুবকটিকে উদ্ধার করেছে। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন পুলিশকে খবর দিয়েছিল। খবর না দিলে যুবকটি গণপ্রহারের শিকার হয়ে ওখানেই মারা পড়ত। হিন্দু আর মুসলমান দুপক্ষই যেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিছুতেই তারা হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হতে দেবে না। বিয়ে তো দূরের কথা, প্রেম করলেই রক্তারক্তি ঘটায়। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। দুদিন আগে খেত্রাম ভীম নামে এক রাজস্থানী দলিত যুবককে মুসলমানেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, খেত্রামের অপরাধ, সে এক মুসলমান মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।

দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে প্রেম না থাকলে, একত্রবাস বা বিয়েশাদি না হলে, আস্থা বা বিশ্বাস না জন্মালে কী করে সম্ভব সুখে শান্তিতে এক সমাজে বাস করা? যে যত কথাই বলুক, ঘৃণা কোনও সমাধান নয়। শেষ অবধি ভালোবাসাই সমাধান। মুশকিল হলো, ধার্মিকরা কখনও কাউকে মানুষ হিসেবে বিচার করে না, তারা মানুষকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদি হিসেবে দেখে। একজন মানুষ আরেক জন মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করছে, এভাবে ভাবতে শেখেই নি। কিন্তু এসব শুধু গরিব আর মধ্যবিত্তদের বেলায়। উচ্চবিত্ত, জনপ্রিয়, নামিদামি তারকা হলে অবশ্য অন্য কথা। শাহরুখ খান, আমির খান, সাইফ আলী খান, সেলিম খান হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করলে কেউ তাঁদের মেরে ফেলে না, পিটিয়ে তাঁদের সর্বনাশ করে না। সুনীল দত্ত, কৃষণ চন্দর, হৃত্বিক রোশন, কিশোর কুমার মুসলমান মেয়েদের বিয়ে করলে কোনও অসুবিধে হয় না। উচ্চবিত্ত সমাজে হিন্দু মুসলমানের বিয়ে আকছার হচ্ছে। তাহলে কি এ-ই সত্য যে, উচ্চবিত্তরা উদার, আর যত অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের মধ্যে? অনেকে বলে অশিক্ষিতদের মধ্যে সংকীর্ণতা প্রচণ্ড, সে কারণে তারা দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে ঘটতে দিতে চায় না। গরিব এবং মধ্যবিত্তরা সকলে অশিক্ষিত, ধার্মিক, আর উচ্চবিত্তরা সকলে শিক্ষিত, অধার্মিক—এরকম ধারণা একেবারেই ভুল। বরং দেখা যায়, উচ্চবিত্ত তারকাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি নয়, তাঁরা ধর্ম কর্ম করেন না এও ঠিক নয়, কিন্তু যত অনায়াসে তাঁরা ভিন্ন ধর্মী কাউকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন, তত সহজে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাও পারেন না।

ভারতীয় উপমহাদেশেই আন্তঃধর্মীয় বিয়ে কম হয়। কিন্তু সভ্য দেশগুলোয় আজকাল আন্তঃধর্মীয় বিয়ের হার আগে যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। ক্যাথলিক ইহুদিকে বিয়ে করছে, ইহুদি প্রটেস্টান্টকে বিয়ে করছে, মরমন এপিস্কোপালিয়ানকে বিয়ে করছে, নাস্তিক জিহোভাস উইটনেসকে বিয়ে করছে। কোনও শ্রেণির মধ্যেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে বা একত্রবাসের কারণে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। গোল বাঁধছে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রেম বা বিয়ে ঘটলেই। দু’ পক্ষ বা এক পক্ষ বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে। আজকাল হিন্দু মেয়ে বা ছেলে যদি ক্রিশ্চান বা ইহুদি বা বৌদ্ধ বা পারসি বা শিখ ধর্মের কাউকে বিয়ে করে, কেউ তেড়ে আসে না। কিন্তু মুসলমানকে বিয়ে করলে তেড়ে আসে, এ বিয়ে অধিকাংশ হিন্দুই সহজে মেনে নেয় না। তবে বিত্তশালী মুসলমান হলে তেমন আপত্তি ওঠে না, বিত্তশালী দলিতের সঙ্গে গরিব ব্রাহ্মণের বিয়েও অনায়াসে হয়ে যেতে পারে।

মুসলমানদের সমস্যাটা হলো, তাদের অধিকাংশই বিধর্মী সঙ্গীকে নিজেদের ধর্ম পালন করতে দিতে চায় না, ইসলাম ধর্মে সবাইকে ধর্মান্তরিত করে নেয়। এ কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানকে বিয়ে করার আগে মানুষ দুবার ভাবে। যে মুসলমানরা তাদের বিধর্মী সঙ্গীকে মুসলমান হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে না, তাদের সম্পর্ক টিকে থাকে দীর্ঘকাল। মুসলমানকে উদার হতে হবে। একই সংগে হিন্দুকেও হতে হবে উদার। মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য মুসলমানদের মিশনারি বা ‘লাভ জিহাদি’ কোনওটাই সাজা ঠিক নয়। ভারতবর্ষে হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে শান্তি বিরাজ করবে, যত বেশি তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হবে এবং বিয়ে হবে, যত বেশি তারা সন্তান জন্ম দেবে, যত বেশি তারা পরস্পরের আত্মীয় হবে, ধর্ম-পরিচয় যত বেশি ক্ষীণ হবে, যত অকিঞ্চিতকর হবে।

কঠোর সত্য এই যে, ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু আর মুসলমানকে একসঙ্গে বাস করতে হবে। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। হিন্দু বা মুসলমান কোনও একটি সম্প্রদায়কে দেশের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া অথবা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব নয়। এক সঙ্গেই যেহেতু বাস করতে হবে, এক সঙ্গে সুখে শান্তিতে বাস করার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইলে যেটা দরকার সেটার নাম পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা। হিংসে, ঘৃণা, বিদ্বেষ বাদ দিয়ে শ্রদ্ধার চর্চা না করলে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ এবং দূরত্ব ছাড়া আর কিছু বাড়বে না।

ধর্মের কারণে দেশ ভাগ হয়েছে আজ সত্তর বছর। এই সত্তর বছরে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সম্পূর্ণ দূর হয়নি। অদৃশ্য একটি ‘দেশভাগ’ দেখি ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষের মুসলমান বহিরাগত নয়, বহিরাগতদের ধর্ম গ্রহণ করেছে মাত্র। তারপরও কট্টর হিন্দুরা মুসলমানদের বহিরাগত হিসেবে দেখে। কট্টর মুসলমানরাও যত না ভিনদেশি মুসলমানকে আপন মনে করে, দেশি হিন্দুকে ততটা আপন মনে করে না। হিন্দু এবং মুসলমান কট্টরপন্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা যদি আগুনের মতো ছড়াতে থাকে, ভয় হয় কবে না জানি আবারও দু টুকরো হয়ে যায় দেশ। আমাদের তো কথা ছিল পৃথিবীকে এক করার! সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn