এম আজাদ, প্যারিস : গত ১৭ই মার্চ ২০১৭ইং ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে একটি চমৎকার প্রাণবন্ত (চিৎকার, চেচামেচি,হট্রগোল) দিবস পালিত হয়ে গেল, আমরা যারা সাধারণ প্রবাসী বাঙালি এখানে আছি তারা আসলে কর্মক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে হয়তো উপস্থিত হতে পারিনি, তাদের জন্য হতাশ হওয়ার কারণ নেই, কারণ তথ্য প্রযুক্তির কল্যানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব মহান দিবসের কার্যসূচীসমূহ সরাসরি বা পরবর্তীতে একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাওয়া যাবে, আমার মনে হয় বিশ্বের আর কোন দেশের বাংলাদেশ মিশনে এরকম নিন্দনীয়, ঘৃণিত ও ন্যক্কারজনকভাবে জাতীয় দিবস পালনের ঘটনা ঘটেনি, অন্তত কোন সংবাদ মাধ্যমে তার খবর পাওয়া যায় নি। দেখা যাক ফ্রান্স এ একের পর এক এরকম নিন্দনীয় ঘটনার শানে নুযুল বের করতে পারি কি না—
১. অপরিপক্ক কমিউনিটি নেতৃত্ব : বিদেশে যারা বেশিদিন থেকে বসবাস করেন এবং বয়সের দিক দিয়ে প্রবীণ বস্তুত উনাদেরকেই কমুনিটির নেতৃত্বের বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফ্রান্সে তাহার ব্যতিক্রম কিছু না, কিন্তু এখানে যেটা লক্ষ্য করা যায় , প্রবীণদের অনভিজ্ঞতার কারণে হোক আর নিজেদের অপারগতা বা দক্ষতার অনুপস্থিতির কারণেই হোক তুলনামূলকভাবে কম বয়সের কিছু উদীয়মান প্রবাসীরা এখানে নেতৃত্ব দেয়ার একটা প্রয়াস চালিয়ে আসছে, তাদের কথায় তেমন কোন মাধুর্য নেই, নেই ধৈর্যশীলতা যা আছে তা হচ্ছে অজস্র কথা, অফুরন্ত ভাষণ আর চিৎকার। শুধু কথা দিয়ে, চিৎকার কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে যদি কোনো জাতি উন্নতি কিংবা শ্রেষ্ঠ হতে পারত তবে নিঃসন্দেহে আমাদের চেয়ে উন্নত, শ্রেষ্ঠ জাতি পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। কিন্তু কথার ফুলঝুড়ি, বক্তৃতার বেসাতি, প্রতিশ্রুতির বন্যা, অনিঃশেষ মিথ্যে পংক্তিমালার চিৎকার আমাদের সমস্ত গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়েছে।কর্ম-বিমুখ কথা এবং উৎকট চিৎকারে উচ্চারিত বক্তৃতা সমস্ত এগিয়ে চলার পথ আঁধারে ঢেকে দিয়েছে। কেন যেন মনে হয় উনাদের মধ্যে কোন একটা সংকুচতা কাজ করে, সকলের সম্মুখে একতাবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে আড়ালে কমিউনিটিতে বিভেদ সৃষ্টি হয় এমন কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকতে স্বাচ্ছন্ধবোধ বেশি করেন। তাই সঠিক দক্ষ নেতৃত্ববিহীন একটি কমিউনিটি এরকম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবক্ষয় নিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
২. লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতি : আমরা যেটা অতি সহজ ভাষায় বুঝতে পারি, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে দেশের ও জনগণের উন্নয়নের জন্য রাজনীতির বিকল্প কিছুই নেই, কারণ এর মাধ্যমেই ক্ষমতার একটি পর্যায়ে গিয়ে জনগণের কল্যানে কিছু করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু একটি বিষয় কোনভাবেই বোধগম্য হয়না যারা মাতৃভূমিতে সেই কল্যাণ করার অদম্য ইচ্ছায় সফল না হয়ে দেশ ত্যাগ করে জীবন জীবিকার তাগিদে নিজেদেরকে এবং ফেলে আসা পরিবারকে একটি সফলতার অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে আসছেন তারা কেন আবার সেই দেশীয় রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে এরকম একটা সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করেন ? এসব দেশীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রবাসী কমিউনিটি যদি কিঞ্চিৎ পরিমান লাভবান হতো তাহলে হয়তো কিছু সময়ের জন্য সেটা মেনে নেয়া যেত, লাভ যেটা হচ্ছে সেটা হলো এখানের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক গ্রূপিং সৃষ্টি করে নেতারা তাদের বিভিন্ন দেশে সফরের সময় বেশিসংখ্যক কর্মী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে আর নিজেরা বলির পাঠা হয়ে ছাগলের তিন নং বাচ্চার মতো লাফালাফি করতেছে, পথে-ঘাটে, রেডিও-টিভিতে, পেপার-পত্রিকায় সব জায়গায় কথা আর বক্তৃতা, অভিযোগ আর বিষোদগার, আত্ম-প্রশংসা আর কৃতিত্ব প্রচার, গালাগালি আর ঝগড়া, নোংরামি আর মিথ্যাচার, আস্ফালন আর উস্কানি। প্রতিনিয়ত চলছে পরস্পরের মধ্যে সহিংসতা।আর আমরা সাধারণ প্রবাসীরা বিভিন্ন স্থানে এসব হীন রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক ঘটনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে একটি অসভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছি।
৩. শিষ্টাচার : একটি সভ্য- সুশীল সমাজ ব্যবস্থায় ছোটরা বড়দের সম্মান করবে আর বড়োরা ছোটদের স্নেহ করবে, একজনের বিপদে আপদে আরেকজন এগিয়ে আসবে সুখে-দুঃখে একে ওপরের পাশে থাকবে এরকমই হওয়ার কথা, বিশেষ করে প্রবাসে তার প্রয়জোনীয়তা আরো বেশি গুরুত্ব বহন করে, কিন্তু এখানে এই বিষয়টির যেন বড়োই অভাব, আজকাল কেউ কাউকে সম্মান দিতে রাজি নয়, উদাহরণ হিসেবে গত ১৭ মার্চের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়, যেকোন কারণেই হোক অনুষ্টানের এক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার অবতারণা হলে সেখানে শুধু বয়সে বড়োই না, আমাদের রাষ্ট্রীয় অভিভাবক হিসেবে মান্যবর রাষ্ট্রদূত একাধিকবার অনুনয় করে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি, কতটুকু শিষ্টাচার বিবর্জিত হলে একটি জনগোষ্ঠী এরকম করে আচরণ করতে পারে সেটা আপনাদের  বিবেকের কাছেই প্রশ্ন থাকলো; আর এসব অনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে একে একে আমরা সকল জায়গায় নিজেদের উপস্থিত হওয়ার অধিকারটুকু নিজেরাই নষ্ট করে চলেছি, জানিনা এই হিংস্র খেলার শেষ কোথায় ? ? ধারণা করা হয় ফ্রান্সে ২৫ – ৩০ হাজার বাংলাদেশী অভিবাসীদের বসবাস,আর এরকম অপ্রীতিকর ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা বেশি হলে এক শত (১০০) থেকে দুই শত (২০০), বুঝাই যায় যে সংখ্যায় এরা কত নগন্য কিন্তু কমিউনিটির যে ক্ষতি সংঘটিত হচ্ছে তার দ্বায়ভার কিন্তু পুরো ২৫ – ৩০ হাজারকেই বয়ে বেড়াতে হয়, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে আমি একজন সাধারণ প্রবাসীই অন্যের কৃতকর্মের দন্ডের ভার নিজের কাঁধে কেন নেব ?
পরিশেষে ,…  মতো নিজেকে বাজি রেখে দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সংঘর্ষে চরম ব্যর্থতায় নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে লাঞ্ছিত, প্রবঞ্চিত, প্রতারিত ও নিপীড়িত হয়ে কর্মহীন অনিশ্চিত জীবনের প্রবল যন্ত্রণায় নিজেদের অস্তিত্ব বেমালুম ভুলে গিয়ে মানবকল্যাণের সমস্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে, লোভ-লালসার নানান প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে নিজের সততা এবং সত্যকে বিসর্জন দিয়ে মিথ্যার কাছে আত্মবিক্রয়, লোভের কাছে নতি স্বীকার এবং ভোগের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে অর্থ-ঐশ্বর্য্য, মান-মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠার পিছনে ক্ষুধার্ত হায়নার মতো হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যেখানে শ্রদ্ধা-ভক্তি, আদর-স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা কিছু নেই। নেই জীবনের আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ, সততা, নৈতিকতা এবং মানবতা, সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে আসুন আমরা আমাদের কমিউনিটির অন্যান্য আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন – নবাগত প্রবাসীদের প্রাথমিক সহায়তা প্রদান, বিদেশিদের ছিনতাই-আক্রমণ এর হাত থেকে রক্ষা করা, এবং বেশি করে আমাদের বাঙালিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এসব নিয়ে কাজ করি একদিন সমাজ আপনার প্রাপ্য পুরস্কারটি আপনাকে নিজে থেকেই আপনার হাতে তুলে দেবে। আমার লিখার মধ্যে কেউ নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করবেন না, আশা করি নিজেদের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে যে যেখান থেকে যেভাবে সম্ভব ভাল কাজ করে একটি সুষ্টু, সংঘাতহীন সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ বিনির্মানে কাজ করে যাই, পরিবর্তন আসবেই ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn