লুসাইবার মা হামিদা আলীর ফেসবুক স্ট্যাটাস-

আমি লুসাইবার মা হামিদা আলী। আপনাদেরকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমাদের কলিজার টুকরো, অত্যন্ত আদরের মামনি ১৫ মাস বয়সী মালিহা জান্নাত লুসাইবা আর নেই। ঢাকা শিশু হাসপাতালের ভুল চিকিৎসা আর অবহেলায় গত সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। সে আর কোনদিন আসবে না, আর আমাকে আম্মু, আম্মু বলে ডাকবে না, আর কোন দিন তার হাত বুলিয়ে আদর করবে না। ঢাকা শিশু হাসপাতালের ওরা চিকিৎসক নয়, ওরা কসাই। নিরব নিথর করে দিয়েছে আমাদের মা লুসাইবাকে। ওরা আমার শিশুটিকে গিনিপিগ বানিয়ে দীর্ঘ প্রায় দুই মাস ধরে রীতিমতো এক্সপেরিমেন্ট চালালো। ওদের ভুল চিকিৎসা আর অবহেলার শিকার হয়ে চলে গেলো আমার মেয়েটা। কিন্তু কেন বলছি ভুল চিকিৎসা, কিরকম অবহেলা হয়েছিলো সেখানে দয়া করে সেটা শুনুন :

—আমরা গত ২০/১১/১৮ তারিখে লুসাইবাকে নিয়ে শ্যামলীর ঢাকা শিশু হাসপাতালে যাই। ওর সমস্যা ছিলো গায়ে জ্বর ও হাত পায়ে ব্যথা। আউটডোরের ডা. দেলোয়ার পর্যবেক্ষণ করে জানালো, ওর স্কার্ভি (scurvy) হয়েছে। এরপর একজনকে বললো, এই রোগীর একাডেমিক বিষয় আছে, শিশুটাকে ভর্তি নিয়ে নাও। এরপর অধ্যাপক ডা. সেলিমুজ্জামান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেনের অধীন থ্যালাসেমিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করা হলো।

—লুসায়বাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতো সহযোগী অধ্যাপক ডা. বেলায়েত, ডা. ওহাব, ডা. সাজেদা। কিছুদিন পর তারা জানালো, ওর একুইট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) হয়েছে। ওরা তিন বার বোনম্যারো পরীক্ষাটা নাকি করেছিলো কিন্তু কোন রিপোর্টই আমাদেরকে দেয়নি/দেখায়নি। অথচ (তাদের পরামর্শেই) ১০ হাজার টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল থেকে বোনম্যারো পরীক্ষার রিপোর্ট আসে শূন্য। সেই রিপোর্ট আমরা জমা দেই, কিন্তু বাইরের রিপোর্ট বলে সেটাকে তারা গ্রহণ করেনি। এরপর একটা কাগজে আমার সই নিয়ে কেমোথেরাপি শুরু করে। প্রথম কেমো দেবার পরই লুসায়বার শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মাথার বিভিন্ন স্থান ফেটে রক্ত পড়া শুরু করে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, অনবরত কান্নাকাটি করতে থাকে মেয়েটি আমার।

—এই পরিস্থিতিতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে আর চিকিৎসা করাবো না। তাকে ভারতে নেবার সিদ্ধান্ত নেই। জরুরী ভিত্তিতে পাসপোর্টের টাকাও জমা দেই এক লোকের কাছে। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ছবি তোলার জন্য এক ঘণ্টার ছুটি চাইলে শিশুটির অবস্থা ভালো না বলে ডা. বেলায়েত এবং সেখানকার নার্সরা কোনমতেই আমাদেরকে বাইরে যেতে দেয়নি। কয়েকদফা চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ হই। আমাদেরকে সরাসরি বলা হয়েছে, বাইরে যেতে চাইলে রিলিজ নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কেমো চলাকালীন চলে গেলে আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে ভেবে রিলিজও নিতে সাহস পেলাম না। আমরা ভারতে যাবো এটা জানার পর ওখানকার এক ডাক্তার মন্তব্য করলো, ‘ইস ওরা বাংলাদেশের টাকা ভারতে পাঠাতে ভারত যাবে…!’

—এই অবস্থাতেই তারা আবারো দ্বিতীয় কেমোথেরাপি শুরু করে। ভয়ংকর এই থেরাপি দেবার পর লুসায়বার ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়া, অববরত বমি হওয়া এবং হাত পা জ্বলার মতো মারাত্বক কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। জরুরী পরিস্থিতিতে বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে সেখানে ডাক্তার ডাকলেও কাউকেও আমরা পেতাম না! মারা যাবার আগের রাত থেকে মেয়েটি অনবরত বমি করলো অথচ সঠিক চিকিৎসা পেলাম না। পরদিন ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিলো, এরপর পেট ফুলতে শুরু করলো।

—তাদের রিপোর্টে জানলাম, একদিনের মাথায় লুসাইবার ডব্লিউবিসি কাউন্ট ১০০ এবং প্লাটিলেট ১০ হাজারে নেমে গেলো। এরপর গত বরিবার (১২ জানুয়ারি) তারা কি যেন এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো ফুলতে শুরু করলো পেট। দুপুরের দিকে অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে তারা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নিতে বললো। সেখানে বেড খালি না থাকায় তাদেরই পরামর্শেই কেবিনে স্থানান্তর করি।

—লুসাইবা যখন ওয়ার্ডে সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলো তখন মুখে সারাক্ষণ অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিলো। কিন্তু ভিআইপি কেবিন ভাড়া বাবদ সাড়ে ৪ হাজার টাকা জমা দিয়ে কেবিনে গেলেও সেই রুমে পেলাম না কোন অক্সিজেন মাস্ক, মনিটর বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, ওয়ার্ডে যে চিকিৎসা হয়েছিলো সেই কাগজপত্র (রেকর্ড ফাইল) ও অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে না দিয়েই ওয়ার্ড থেকে লুসায়বাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। লুসাইবার শ্বাষকষ্ট বেশি হচ্ছিলো। আমরা কান্নাকাটি করছিলাম এটা দেখে সেখারকার নার্সরা (মেট্রন পর্যন্ত) পর্যন্ত কান্নাকাটি শুরু করে। একপর্যায়ে পাশের রুম থেকে অক্সিজেন এনে দেয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পর আমাদের আদরের মামণি লুসাইবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।

—লুসাইবার লাশ নিয়ে আমরা যখন রওনা দেই আমাদেরকে শুধু ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হলো। কোন রিপোর্ট দেয়া হলো না। তারা রেখে দিলো।

আমাদের প্রশ্ন হলো :
—আসলেই কি ব্লাড ক্যান্সার (এএমএল) হয়েছিলো লুসায়বার? ব্ল্যাড ক্যান্সার হয়েছে এটা তাদের পরীক্ষায় প্রমাণ হলো অথচ পিজি হাসপাতালেরটা রিপোর্টটা কেনো তারা গ্রহণ করলো না?? আমার scurvy রোগের মেয়েটাকে cancer এর ভুল চিকিৎসা দিয়ে ওরা কেন মেরে ফেললো?
—আমরা ভারতে যেতে চাইলাম তারা কেন আমাদেরকে ভারতে যেতে দিলো না? ভারতে যাওয়া নিয়ে ওরা কেন টিটকারী করলো? 
—ব্লাড ক্যান্সারে কেমোথেরাপি দিয়ে যদি শিশু না-ই বাঁচে তবে কেনো দেয়া হলো এই থেরাপি? কোন দরকার ছিলো না কি এই চিকিৎসার? বরং চিকিৎসার আগেইতো সে ভালো ছিলো। অথচ এরপরও আমাদের সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হলো। হাসপাতাল থেকে বেড বাদে আর কিছুই দেয়া হতো না।
—আল্লাহর পরেই তো মানুষ ডাক্তারকেই বিশ্বাস করে। আমরাও তাদেকে বিশ্বাস করে কি ভুল করেছিলাম? আমার মেয়েটা কি শুধুই একাডেমিক বিষয় ছিলো তাদের কাছে? আমার মতো গরীব মানুষের ছোট্ট মেয়েটিকে দিয়ে ওদের এই জঘন্য একাডেমিক কাজ না চালালে কি হতো না? 
—লুসাইবার সংকট মুহূর্তে কোন ফাইল ছাড়া এবং অক্সিজেন ছাড়াই কেন কেবিনে স্থানান্তর করা হলো? 
—লুসাইবার লাশ নিয়ে আমরা যখন রওনা দেই আমাদেরকে শুধু ডেথ সার্টিফিকেট কেন দেয়া হলো। রিপোর্টগুলি কেন দেয়া হলো না?

—এতদিন শুধু সংবাদে দেখে এসেছি, চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যায় কিন্তু আজ আমি নিজেই তার শিকার হলাম! বলিদান দিলাম আমাদের মেয়ে লুসাইবাকে। ওরা জানে আমি এর প্রতিবাদ করতে পারব না। লুসাইবাকে হারিয়ে আজ আমরা পাগলপ্রায়। কি সুন্দর করে সে তাকিয়ে থাকতো। আমাকে মা মা বলে ডাকতো, আমার, ওর বাবার কপালে চুমু খেতো। ফুটফুটে সেই মেয়েটি আজ কবরে! আপনারা ভাবুন, কারো পরিবারে এমনটি হলে কী অবস্থা হতো?
—ঢাকা শিশু হাসপাতালের থ্যালাসেমিয়া ওয়ার্ড একটা মৃত্যুপুরী যেখান থেকে খুব কম সংখ্যক শিশুই বেঁচে আসে। আরো দুই শিশুকে এভাবে মারা যেতে দেখলাম সেখানে থাকাকালীন। অথচ ওখান থেকে যারা ছুটি নিয়ে ভারতে চলে গেছে তারা এখনো ভালো আছে। রহস্যজনক ওদের পরীক্ষানিরিক্ষা, রহস্যজনক ছিলো ওদের চিকিৎসা! এর শেষ কোথায়? 
—সুস্থ সমাজে তাদের কি বিচার হবে না…? সরকার কি এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবে না…?

ভুল চিকিৎসা আর অবহেলায় আমাদের কলিজার টুকরা, আদরের মামনি লুসায়বার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের তদন্ত সাপেক্ষে বিচার চাই। আমরা গরীব মানুষ, সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনতে আপনারা সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা চাই, আর কোন বাবা মায়ের বুক খালি না হোক। শিশুদের গিনিপিগ বানিয়ে তাদের জঘন্য এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ হোক।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn