র‍্যাবের কথিত ক্রসফায়ারের সময় টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হকের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোনের একটি সচল থেকে গিয়েছিল। সংযুক্ত ছিল অন্য প্রান্তে থাকা স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনের সঙ্গে। আর তাতেই রেকর্ড হয়ে যায় হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত। আয়েশার অভিযোগ, সেই মুঠোফোনটি জিম্মায় নিতে উঠেপড়ে লেগেছে একটি পক্ষ। গতকাল বুধবার টেকনাফের খালিয়াপাড়ায় একরামুল হকের পৈতৃক বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল একরামুলের বিধবা স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, গত জুলাইয়ে র‍্যাব পরিচয়ে এক ব্যক্তি তাঁদের বাসায় এসে মুঠোফোনটি চান। প্রথমে তিনি তাঁর ও তাঁর মেয়েদের ক্ষতি হতে পারে বলে হুমকি দেন, পরে ২০ লাখ টাকা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ওই দিন তিনি আয়েশা বেগমদের বাসায় বিকেল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন। একরামুলদের পরিবারের আশঙ্কা, একরামুলের খুনিরা হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ মুছে ফেলতেই এই চেষ্টা চালিয়েছিল। তাঁরা কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় যে মামলা করেছেন, সেই মামলার জব্দ তালিকাতেও একটি মুঠোফোন উল্লেখ করেছে। অথচ একরামুল তিনটি ফোন ব্যবহার করতেন। এখনো একরামুলের ফেসবুক প্রায়ই লগ ইন হয়, কিন্ত কারা করেন, তা তাঁরা জানেন না।

আয়েশার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বাসায় গিয়ে কেউ আয়েশা বেগমের মুঠোফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই। বিষয়টা এমনও নয় যে তাঁর ওপর কেউ নজরদারি করছে। গত বছরের ৪ মে দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে একরামুল হককে হত্যার অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২৬ মে হত্যাকাণ্ডটি ঘটার সময় মেয়েদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, তাঁকে গুলি করার আগে-পরে একটি কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে যে যে বিবরণ থাকে, তার সবটাই শোনা যায় ফোনে থেকে যাওয়া রেকর্ডে।

গতকাল আয়েশা বেগমের সঙ্গে যে ঘরে বসে কথা হচ্ছিল, সেটি তাঁদের যৌথ পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়ার ঘর। কথার ফাঁকে বারবারই চোখ চলে যায় ঘরটির দেয়ালজুড়ে একরামুলের দুই মেয়ের আঁকা ছবি ও ছোট ছোট বাক্যের দিকে, ‘মানুষ কত খারাপ, আমাদের আব্বু থেকে আমাদেরকেই আলাদা করে দিল।’ আয়েশা জানান, তাঁদের চুপ করে থাকতে বলা হয়েছে। তবে চুপ করে থাকলেও তিনি ও তাঁর দুই মেয়ে এই অবিচারের কথা ভুলবেন না। তাঁরা হত্যাকাণ্ডের বিচার আমৃত্যু চেয়ে যাবেন। কে চুপ করে থাকতে বলেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আয়েশা বেগম বলেন, একরামুল নিহত হওয়ার পাঁচ দিন পর তিনি কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করে অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেন। এরপরই সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ৯ মাস কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত দেখা করার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। একরামুল হক উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন, তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর বাবার রেখে যাওয়া ৪০ বছরের পুরোনো বাড়ির এক কক্ষে থাকতেন। ব্যাংকে টাকাপয়সা নেই, ধারদেনা করে পৈতৃক ভিটায় বাড়ি তোলার কাজ শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে সেদিন সন্ধ্যায় যখন বের হন, তখন মোটরসাইকেলে তেল ভরার মতো টাকা ছিল না। বাসার উল্টো দিকের একটি হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করে বেরিয়েছিলেন—আয়েশা প্রধানমন্ত্রীকে এই কথাগুলো বলতে চান। তিনি জানতে চান একরামুল হত্যার বিচার হচ্ছে না কেন?

একরামুল কেন খুন হলেন?
একরামুলের স্ত্রী বা পরিবারের অন্য সদস্যরা এখনো নিশ্চিত নন। তাঁরা জানান, হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে টেকনাফে গুজব ছড়িয়েছিল, একরামুল ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনবরত একরামুলকে বিরক্ত করছিল। বারবার বলছিল, একরামুল যেন তাদের এক খণ্ড জমি কেনায় সহযোগিতা করে। তাদের চাপাচাপিতেই একরামুল বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হন। জমির বিষয়টা ছিল অজুহাত। আয়েশা বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর র‍্যাব যে সংবাদ বিবৃতি দেয় তা দেখে মনে হয়েছে একরামুলকে খুন করায় ভীষণ তাড়া ছিল। র‍্যাব লিখেছে, ২৬ মে দিবাগত রাত ১টা ৫ মিনিটে র‍্যাব-৭–এর একটি চৌকস আভিযানিক দল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মেরিন ড্রাইভ এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় গুলিবিনিময়ের সময় যিনি নিহত হন, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যসায়ী ও ইয়াবা গডফাদার টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. একরামুল হক কমিশনার (৪৬), পিতা মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার, নাজিরপাড়া, টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ, কক্সবাজার। একরামুলের বাবার নাম মোজাহার মিয়া নয়, তাঁর ঠিকানাও নাজিরপাড়া না। নাজিরপাড়া পৌরসভার বাইরে, সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৭৩ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১৮ নম্বরে নাম আছে এনামুল হকের, তাঁর বাড়ি নাজিরপাড়া, বাবার নাম মোজাহার মিয়া। এই এনামুল হকই প্রথম গত নভেম্বরে নিজেকে নিরপরাধ ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে ফিরতে চাই নিরাপদ জীবনে’। তিনি এখন আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় পুলিশি হেফাজতে আছেন। বন্দুকযুদ্ধের পর নিয়মানুযায়ী র‍্যাব টেকনাফ থানায় মামলা করে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। বিচার শুরু হলে আয়েশা বেগম অভিযোগ দিলে তা সংযুক্ত করার সুযোগ থাকবে। তবে কবে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে, সে কথা জানাতে পারেননি তিনি। এখন পর্যন্ত মামলার প্রয়োজনে কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি বলে জানিয়েছেন আয়েশা বেগম। আয়েশা বেগমের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘এটা আমার খেয়াল নেই।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn