আবদুল গাফফার চৌধুরী-আমার এক অনুজপ্রতিম বুদ্ধিজীবীর একটি সাক্ষাৎকার দেখলাম ঢাকার কাগজে। তিনি এখন আমেরিকার এক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। দেশে বেড়াতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি’ শীর্ষক যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি যে পুনরুক্তি করেছেন, তাকে এককথায় বলা চলে- মার্কিন চশমায় বাংলাদেশের সমস্যা বিবেচনা করা এবং বাংলাদেশের একটি সুশীল সমাজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়া। আমি তাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। ছাত্রজীবনে সম্ভবত জাসদ করতেন। লন্ডনের বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগে তিনি যখন কাজ করেন, তখন তার সঙ্গে পরিচিত হই। ততদিনে তিনি নিজের পাণ্ডিত্যগুণে জাসদের অ্যাডভেঞ্চারাস রাজনীতির মোহমুক্ত হয়েছেন এবং তার লেখায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও পাণ্ডিত্যের প্রমাণ পাওয়া যেত। তিনি লন্ডন থেকে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও তার লেখা বাংলাদেশ সম্পর্কিত গবেষণামূলক বই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, তার লেখায় যে স্বচ্ছতা ও যুক্তিতর্ক তার আমি প্রশংসা করি। কিন্তু সব বিষয়ে তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি না।

ঢাকায় দেওয়া তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারেও আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে তার অতীতের মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। এই মনোভাবের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সুশীল সমাজ ও তাদের মুখপাত্রগুলোর মনোভাবের বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি এই সুশীল সমাজের পক্ষ নিয়ে সাফাইও গেয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি ঢাকার শীর্ষ স্থানীয় দুই সুশীলের মন্তব্য উদ্ৃব্দত করেছেন। এই দুই সুশীলের একজন বলেছেন, ‘আমি এখন কথা বলতে খুব ভেবেচিন্তে বলি।’ আরেকজন সুশীল বলেছেন, ‘আমি যা ভাবি তা লিখতে পারি না।’ এই দুই মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে প্রবাসী বুদ্ধিজীবী তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি তো দেখছি, গোটা সিভিল সমাজের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চলছে। সিভিল সোসাইটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সিভিল সোসাইটিকে ভাবা হচ্ছে শত্রু। সংবাদপত্রে চলছে সেলফ সেন্সরশিপ।’ এ রকম ঢালাও মন্তব্য ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের হতে পারে; কিন্তু একজন বাংলাদেশি প্রবাসী বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে আশা করিনি। তার সব মতামতের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করতে না পারি; কিন্তু তার গবেষণাশক্তি এবং যুক্তিতর্ককে আমি সম্মান করি। তার লেখা হাতের কাছে পেলেই পড়ি। তিনি বিদেশে থাকেন। মাঝেমধ্যে দেশে এসে এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য করবেন, যা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রকারান্তরে শক্তি জোগাবে, এটা দুঃখজনক। দেশে একটি সিভিল সোসাইটি আছে। স্বাধীনতার আগেও ছিল। তাদের চরিত্র ও ভূমিকা এবং বর্তমান সিভিল সোসাইটির চরিত্র ও ভূমিকা কি এক? পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের একটি এলিট ক্লাস ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে একইভাবে বৈষম্যের শিকার। তাদেরও লড়তে হয়েছে এবং জনগণের লড়াইয়ে অংশ নিতে হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রবাসী বুদ্ধিজীবী তার সাক্ষাৎকারে এলিট ক্লাসের যে দু’জন শীর্ষ নেতার নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের একজনকে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

সেই সিভিল সমাজ আর বর্তমান সিভিল সমাজের চরিত্র কি অভিন্ন? স্বাধীনতার পর এই স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি সিভিল সমাজ। তারা রাতারাতি প্রিভিলেজড ক্লাস বা সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। পাকিস্তান আমলে ড. শহীদুল্লাহ্‌র মতো মনীষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হতে পারেননি। স্বাধীনতার আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলের কৃপায় যারা ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ক’জন জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় ও মেধায় এ পদের যোগ্য? আমি যোগ্যদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এ কথা বলছি। আমাদের বর্তমান সিভিল সমাজে সাহসী ও সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী নেই- এ কথা বলছি না। তাদের সংখা আঙুলে গোনা যায়। তাদের বাইরে যে বিপুল ও বৃহৎ সিভিল সোসাইটি তা স্বাধীনতার পর একটি কায়েমি স্বার্থে পরিণত হয়েছে। এই কায়েমি স্বার্থরক্ষার জন্য তারা যে কোনো গণবিরোধী শক্তির সমর্থক ও সহযোগী সাজতে পারেন এবং গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকারগুলোর ভুলত্রুটি বড় করে তুলে ধরে প্রচ্ছন্নভাবে গণবিরোধী শক্তিকে সাহায্য জোগাতে পারেন। পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির পর এদের অধিকাংশের ভূমিকা কী ছিল? তাদের শীর্ষ চার নেতাই কি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অক্সফোর্ডে আশ্রয় নেননি? বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন যখন গড়ে উঠেছে, তখন তারা তাতে অংশ নেননি। বরং তাদের কেউ কেউ সামরিক শাসনের মনোনয়ন নিয়ে জাতিসংঘের কোনো কোনো সংস্থায় চাকরি নিয়ে বিদেশেই আরামে দিন কাটিয়েছেন। আমার বলতে দ্বিধা নেই, দেশে যখনই কোনো গণবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে, তখন আমাদের এই সিভিল সোসাইটির বড় অংশই তার সহযোগী হয়েছে, বেনিফিশিয়ারি হয়েছে। তারপর এই সিভিল সোসাইটি কর্তৃক সমালোচিত রাজনৈতিক দলটির নেতারা যখন প্রাণবাজি রেখে (শেখ হাসিনার জীবনের ওপর ১১ বার হামলা হয়েছে) দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন, তখন এই সিভিল সোসাইটির শীর্ষ নেতারা গণতান্ত্রিক সরকারের ভুলত্রুটিগুলো আবিস্কার ও প্রচারে ব্যস্ত থাকেন। তাতে সুবিধা পায় গণবিরোধী শক্তি।

আমাদের সিভিল সোসাইটির এককালে শক্তি ছিল গণসম্পৃক্ততা এবং জনগণের সমর্থন। এখন তাদের নির্ভরতা বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার আর্থিক ও অন্যান্য উদ্দেশ্যমূলক সাহায্যের ওপর। এই আর্থিক সাহায্যে তারা নানা আলোচনাচক্র, গোলটেবিল বৈঠক করেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কোনো পশ্চিমা দেশ যেসব অভিযোগ তোলে, দেশের ভেতরে তার ইকো সৃষ্টি করেন। এ জন্যই মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাদের কণ্ঠে। জনগণের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তারা নিশ্চুপ থাকেন। মানবাধিকার, কথা বলার অধিকার ইত্যাদি উচ্চমার্গের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। প্রবাসী বুদ্ধিজীবী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চলছে। সিভিল সোসাইটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সিভিল সোসাইটিকে শত্রু ভাবা হচ্ছে।’ তার এই মন্তব্যটি সঠিক নয়। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির একটা আত্মধ্বংসী ভূমিকা রয়েছে। তাদের সুবিধাভোগী ভূমিকা, গণবিরোধী শক্তিকে ক্রমাগত সহযোগিতা দানের ভূমিকাই সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। নইলে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোও এই সিভিল সোসাইটিকে উচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন দীর্ঘ সংগ্রামের শেষে জনগণ একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আয়োজন করে, তখন সেই সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ডেকে এনেছিল। তিনি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী। তিনি ছিলেন সিভিল সোসাইটিরও একজন শীর্ষ নেতা। দায়িত্ব তিনি ঠিকভাবেই পালন করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং এই সংগ্রামের নেতাদের সম্পর্কেও দেখা গেল তার মধ্যে একটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব। তিনি একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘সামান্য লাঠিপেটা’। এই মন্তব্য দ্বারা তিনি তার সম্মান হারান।

১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিরাট জয়ের পর আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখনও দেখা গেছে, তারা প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক নেতাকে নয়, বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো একজন অদলীয়, অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বকেই অনুরোধ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে বসার কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, তিনি দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের খপ্পরে পড়ে গেছেন। সুশীল সমাজের এক নেতা তার কনসান্সকিপার হয়ে বসেছেন। রাষ্ট্রপতি তাদের পরামশে চালিত হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পশ্চিমা কূটনীতিকদের টুয়েসডে ক্লাব। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান মেরি। ২০০১ সালের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ও হিংস্র মৌলবাদী জোটের ক্ষমতা দখলের পেছনে ছিল দেশের সুশীল সমাজের একটা বড় ভূমিকা। তারপর দেশে নেমে এসেছিল কী ভয়ানক অত্যাচার, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, সংখালঘু পীড়ন এবং সেক্যুলার শক্তিকে দমন- তা আজ ইতিহাস। আর এই ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে সুশীল সমাজের যে ভূমিকা ছিল, সেই ভূমিকাই তার সম্মান ও মর্যাদা, ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করেছে। কোনো সরকারের পক্ষে এই মর্যাদা ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সুশীল সমাজ উচ্চকণ্ঠ, দেশে এক-এগারোর আধা-সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর সেই সিভিল সোসাইটির এক শীর্ষ নেতা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যই সর্বাগ্রে সেই সরকারের দেওয়া চাকরি নিয়েছেন। কোনো সরকার তাদের ধ্বংস করেনি বা করতে চাচ্ছে না। তারা ভীষ্ফ্মের মতো নিজেরাই শরশয্যা গ্রহণ করেছেন, নিজেদের ধ্বংস করেছেন?

প্রবাসী বুদ্ধিজীবী সিভিল সোসাইটির শীর্ষ নেতার যে মন্তব্যটি সমর্থন করেছেন তা হলো, ‘তারা এখন কথা বলতে ভয় পান।’ বর্তমান সরকার তাদের মনে এই ভয় ঢোকায়নি। তাদের মনে ভয় ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে সাহস ও নৈতিক বলের অভাবে। ব্লগার হত্যাকারী ধর্মান্ধদের একজনের পর একজন ব্লগার হত্যাকাণ্ড দেখে তারা সাহস এবং নৈতিক বল হারিয়েছেন। ফলে তারা স্বাধীনভাবে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। ওই হত্যাকাণ্ডের যেমন তারা প্রতিবাদ করতে পারেননি, তেমনি নিজেরা কথা বলার সাহস হারিয়েছেন। যে মুষ্টিমেয় সৎ বুদ্ধিজীবী এই সাহস ও নৈতিক বল হারাননি, এদের একজন হুমায়ুন আজাদ বহু আগে ধর্মান্ধ অপশক্তির ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যজন ড. জাফর ইকবাল সম্প্রতি একই ঘাতকদের ছুরিকাঘাতে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। আরও মারা গেছেন অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক। এরা কেউ সরকার বা সরকারি দলের হাতে মারা যাননি। মারা গেছেন সরকারের বিরোধী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ ঘাতক দলের হাতে। সরকার এদের কঠোর হাতে দমন করতে গিয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। সরকার এদের দমন করাতেই আজ প্রবাসী বুদ্ধিজীবী একজন মুক্তমনা মানুষ হিসেবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও দেশে বেড়াতে আসতে পেরেছেন এবং কথা বলার সাহস দেখাতে পারছেন।

সিভিল সোসাইটির যে বুদ্ধিজীবী বলেছেন, ‘আমি যা ভাবি তা লিখতে পারি না’- তিনি সরকারের ভয়ে নয়, যে হিংস্র মৌলবাদ সমাজ জীবনে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে, সেই অবস্থার মধ্যে বাস করে নিজের অভিমত প্রকাশ করতে পারছেন না। যদি তাকে মুরতাদ আখ্যা দেওয়া হয়, কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়। বর্তমান সরকারও এই অবরুদ্ধ সামাজিক অবস্থা দূর করার জন্য চেষ্টা করছে। আর যে গণবিরোধী রাজনীতি এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে এবং তাকে রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছে, আমাদের সিভিল সোসাইটি তাদেরই সহায়তাদানের পরোক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের এই ভূমিকাই তাদের জন্য আজ ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছে। প্রবাসী বুদ্ধিজীবী তার সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত করেছেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচনে স্বচ্ছতা নেই, দেশের নাগরিকরা নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কিনা এ নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি না’- এই অভিযোগ বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের। প্রবাসী বুদ্ধিজীবীও এই একই চশমায় বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এটা সম্ভবত দীর্ঘকাল মার্কিন মুল্লুকে বসবাসের ফল। নইলে তিনি দেখতে পেতেন, এক হাতে তালি বাজে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচনে অনিয়ম কিছুটা আছে। তা বিএনপি আমলের মতো অত ব্যাপক নয়। বর্তমানের অনিয়মে দু’পক্ষেরই অবদান আছে। এটা দূর হতে পারে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তাতে দু’পক্ষের নিঃশর্ত অংশ গ্রহণ দ্বারা।

বাংলাদেশে এখনও তার পশ্চাৎপদ সামাজিক অবস্থানের কারণে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। তার স্খলন, পতন বহু আছে। তার জন্য মার্কিন মুরব্বিরা চড়া গলায় কথা বলেন। কিন্তু ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এখন নির্বাচন স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত নয়। মানবিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত নয় এবং জনগণ নিজেদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারেও নিশ্চিত নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মার্কিন নাগরিকদের অধিকার যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে, বৈধ বহিরাগতদের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে, তার তুলনা উন্নত গণতন্ত্রে বিরল। নিজেদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী (হাওয়ার্ড ফাস্ট, পল রবসন, চার্লি চ্যাপলিনসহ) ফ্যাসিস্ট-ম্যাকার্থিবাদ দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়িত হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে বহিরাগত মায়ের কোল থেকে সন্তান কেড়ে নিয়ে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো বন্দিশালায় যেভাবে বন্দি রাখা হয়েছে, তা কি একুশ শতকে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে এবারের নির্বাচনেও স্বচ্ছতা কি বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল? ব্রিটেনের সাম্প্রতিক ইইউ রেফারেন্ডামে (ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট) কী ঘটেছে? নির্বাচনে অনিয়ম ধরা পড়েছে এবং সে জন্য ভোট লিড গ্রুপকে (ইইউ ত্যাগের সমর্থক দল) ৬১ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দোষ নয়। ভিক্টোরিয়ান ভালগার ক্যাপিটালিজম এখন গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দানবমূর্তি ধারণ করেছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গ্রাস করেছে। গণতন্ত্রের অবস্থা তাই সব দেশেই, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অত্যন্ত নাজুক। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলো যখন অপরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে উপদেশ দেয়, তা হাস্যকর শোনায়।

বাংলাদেশে সম্প্রতি কোটা পদ্ধতির বিরোধিতাকারীদের আন্দোলন যেভাবে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমান সরকারের এই একটি বিচ্ছিন্ন ধরনের বিচ্যুতি দ্বারা তার আর সব প্লাস পয়েন্টকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার ‘বাজারি সমালোচনা’ একজন মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীর মুখে শোভা পায় না। তার বক্তব্য আমাকে হতাশ করেছে। দেশে বর্তমানে ভোটাধিকার প্রয়োগে অনিশ্চয়তা বড় সংকট। যেটা তিনি বলেছেন, আসল সংকট দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে লড়াই নয়, আসল সংকট রাজনৈতিক শুভশক্তি ও অশুভ শক্তির মধ্যে লড়াই। এই লড়াইয়েও গণতন্ত্রকে মাঝেমধ্যে শক্তির মহড়া দেখাতে হয়। নইলে গণতন্ত্র টেকে না। বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে তার প্রমাণ আমরা পাইনি? পূর্ণ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব হয়, যখন তার সমাজ অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎমুখী দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পায়। বাংলাদেশে তা এখনও হয়নি। আমরা অন্ধকার অতীতে এখনও ঘুরছি। [সূত্র: সমকাল]

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn