শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে দেশে প্রতি বছরই গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আকারের দিক থেকে বেশ প্রসারিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। যদিও যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক মনোভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতির ফলে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না। শিক্ষাবিদরা বলছেন, গত কয়েক বছরে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে উন্নয়ন হয়েছে সেটি কেবল সংখ্যায়, মানে নয়।বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, ২০০৯ সালে দেশে স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি ও বেসরকারি মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৮১টি। ২০১৭ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৩ টিতে। আর ২০০৯ সালে দেশে কলেজের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৪৭টি। ২০১৭ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪১৯টি। সে হিসাবে এক দশকের কম সময়ে দেশের কলেজের সংখ্যা বেড়েছে এক হাজারের বেশি। এ সময়ে বেড়েছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাও। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৮৩টি। ২০১৭ সালে এসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৪৬৭টি। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়কে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সংখ্যাগত দিক থেকে প্রসার দেখা গেলেও গুণগত মানের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য বলছে, শিক্ষার মানে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার মানের দিক থেকে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৭। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত। তালিকায় বৈশ্বিকভাবে ভারতের অবস্থান ২৭। বাকি দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ৩৮, পাকিস্তান ৬৬ ও নেপালের অবস্থান ৭০তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট ২০১৭’তে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনবহুল দেশটিতে পড়াশোনা শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ বেকার থাকে। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাও নিম্নমানের। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষায়িত বিষয়ের সংখ্যা খুবই কম। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সংখ্যায় বাড়লেই সেটিকে উন্নয়ন বলা যাবে না, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হবে মানে। আর শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা মান নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় দুর্বলতা রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতিকীকরণ, ঘুষসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ধরনের অনিয়ম বর্জনীয়। এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয় না। তাই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। দ্বিতীয়ত. শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব মনোযোগ এখন পরীক্ষায়, শিক্ষায় নয়। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তৃতীয়ত. আমাদের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরে একমাত্র ভরসা শিক্ষা। তাই জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ২৫ ভাগ বা জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
সরকারি বিভিন্ন গবেষণায়ও শিক্ষার নিম্নমানের বিষয়টি উঠে এসেছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান যাচাইয়ে ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা নেই। বিষয়ভিত্তিক শিখনমান যাচাইয়ে লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (লাসি) শীর্ষক জরিপটি চালানো হয় দেশের ৩২টি জেলার ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। এতে অংশ নেয় ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীর ৩১ হাজার ৬২০ জন শিক্ষার্থী। ওই জরিপ প্রতিবেদন বলছে, অষ্টম শ্রেণীর ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। এছাড়া গণিতে দক্ষতা নেই ৬৫ ও বাংলায় ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ব্যানবেইসের তথ্যমতে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানে নিয়োজিত আছেন মোট ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন শিক্ষক। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৭০২ জন শিক্ষকের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। এ হিসাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান করছেন। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির এ সদস্য বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য এগুলো বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। যদিও এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের নয়। যেমন উচ্চশিক্ষা কমিশন করা হয়নি, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলও এখনো গঠিত হয়নি।সূত্র: বণিক বার্তা

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn