আমীন আল রশীদ–০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পরে দেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় সংরক্ষিত আসন। জাতীয় সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত আসনের সদস্য হতে এবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আগ্রহী নারী মনোনয়ন ফরম কিনেছেন—যাদের মধ্যে ছোট ও বড় পর্দার অনেক তারকাও আছেন। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের কাজে ও গুণে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত। কিন্তু তারপরও তারা বলছেন, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে এমপি হতে চান। আরও পরিষ্কার করে বললে তারা ক্ষমতাসীন দলের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হতে চান। প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয়?

অতীতে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো আনুপাতিক হারে প্রতিটি পদের বিপরীতে একজন করে প্রার্থীর নাম দিতো এবং তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের কোনও উদাহরণ দেশের ইতিহাসে নেই। ফলে এবার যে বিপুল সংখ্যক নারী মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তাতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে সংরক্ষিত আসনেও ভোটাভুটি করতে হবে কিনা, তাও আলোচনায় উঠছগণমাধ্যমের খবর বলছে, এফডিসি ও নাট্যপাড়া এখন নায়িকাশূন্য। সবাই নেতাদের বাড়িতে এবং দলের কার্যালয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। এফডিসিতে আসা-যাওয়া করেন বা মডেলিংয়ে যুক্ত, তারাও দৌড়ঝাঁপ করছেন। আওয়ামী লীগের বড় জয়ের পর ‘মৌমাছি’র মতো সবাই আওয়ামী লীগে ভিড় করছেন। শুটিংয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। এবার সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ফরম সংগ্রহ করেছেন ২০ জনের বেশি নায়িকা। এই তারকাদের মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরাসরি ভোটে এমপি নির্বাচিত অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীও  এবার সংরক্ষিত আসনে এমপি হওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। অতীতে দেখা গেছে সংরক্ষিত আসনে এমপি হওয়ার পরে অনেকেই সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছেন। যেমন সংগীতশিল্পী মমতাজ। কিন্তু  কবরী এবার দেখাচ্ছেন এর উল্টো। এটি তার নিজের জন্যও কতটা সম্মানজনক, তা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রশ্ন হলো সবাই কেন এমপি হতে চান? আগ্রহীরা এই প্রশ্নের জবাবে গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে চান। তাহলে বিষয়টা কি এমন যে, এমপি না হয়ে জনসেবা বা দেশের জন্য কাজ করা যায় না? নাকি এমপি ছাড়া অন্য কেউ জনসেবা বা দেশের জন্য কাজ করেন না? সম্পূরক প্রশ্ন, আগে জনসেবা নাকি এমপি হওয়া—কোনটা জরুরি? সংসদ সদস্যের সংখ্যা সর্বমোট সাড়ে তিনশ’,  যা দেশের মোট জনসেবকের তুলনায় অতি সামান্য। তাহলে যারা এমপি নন, তারা কীভাবে জনসেবা করছেন? প্রত্যেকেই তার নিজের জায়গা থেকে জনসেবা করতে পারেন। প্রত্যেকে যদি নিজের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সেবাটুকুও ঠিকমতো করেন, তাহলেই তো দেশ বদলে যাওয়ার কথা। তাহলে কি এমপি হওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনা, তাতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো, মাননীয় সংসদ সদস্য বলে সংবর্ধিত হওয়া, বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে পয়সা কামানো?

যদি এই শর্ত দেওয়া হয় যে, এমপি হিসেবে আপনি শুধু সংসদে আইন প্রণয়নেই ভূমিকা রাখবেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা ক্ষমতা ও পয়সা কামানোর অন্যান্য জায়গায় নাক গলাবেন না, তাহলে কতজন এমপি হতে রাজি হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অথচ সংসদ সদস্যের মূল কাজ আইন প্রণয়ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন ফরমের দামও রাখা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা এবং এ বছর দেড় হাজারের বেশি ফরম বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ রাজনীতি যে টাকার খেলা এবং টাকা কামানোর জন্যই যে লোকেরা এমপি হতে চান, এ ঘটনায় সেটিও প্রমাণিত হয় কিনা, সে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর নয়। কারা এমপি হতে চান বা দলগুলো কোন বিবেচনায় সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দলের ত্যাগী নেতারাই মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুকে লিখেছেন, তার পরিচিত এক নারী তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন যেন তাকে টেলিভিশনের টকশোতে ডাকা হয়। অর্থাৎ টেলিভিশনে চেহারা দেখিয়ে তিনি পরিচিত হতে চান এবং সেই পরিচয় দিয়েই এমপি হতে চান। তার মানে জনগণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, টকশোর কারণে মানুষ চিনলেই তিনি এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বা দেখতে পারছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে এরকম একটি বিশ্বাস তাদের মধ্যে জন্মে যাচ্ছে যে, টকশোতে এলেই ক্ষমতার বলয়ে যাওয়ার দরজা খুলে যাবে। যে কারণে টেলিভিশনগুলো অ্যাকাডেমিক বিষয়ে ভালো আলোচক খুঁজে পেতে যেমন একদিকে হিমশিম খায়, তেমনি এ জাতীয় উচ্চাভিলাষী (লোভী) লোককে টকশোতে সুযোগ দিতে নানা জায়গা থেকে তদবিরও আসে। তারা নিজেরাও নানাভাবে টেলিভিশন চ্যানেলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ টকশোতে তিনি আসতেই চান নির্দিষ্ট একটি দলের পক্ষে এবং নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কথা বলতে এবং যার আলটিমেট লক্ষ্য এমপি হওয়া বা ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া। টকশোতে তিনি কী বললেন, সেই কথার গভীরতা ও যুক্তি কতখানি আছে, সেটি কতটা নিরপেক্ষ হলো কিংবা সেই কথা শুনে মানুষ আদৌ কিছু জানলো, নাকি তাকে নিয়ে চায়ের দোকানে লোকেরা হাসাহাসি করে—সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় তার নেই।

সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী সরাসরি ৩০০ জন এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক হারে বাকি ৫০টি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যদিও এই সংরক্ষিত আসনের এমপিদের কাজ ও এখতিয়ার, প্রয়োজনীয়তা, নারী উন্নয়নে সংরক্ষিত আসনগুলো আসলেই কতটা ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে বিভিন্ন সময়েই বিতর্ক হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। বিশেষ করে নবম সংসদে প্রধান দুটি দলের সংরক্ষিত আসনের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের আচরণ ও কথাবার্তায় এই পদটি সমালোচিত হয়েছে। অনেক সময় এমন কথাও উঠেছে যে, সংরক্ষিত আসনগুলো আসলে আলঙ্কারিক কিনা? যুক্তি দেওয়া হয়, নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, তাই তাদের উন্নয়নে সংসদে সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে। পক্ষান্তরে এটিও এখন বাস্তবতা যে, নারীরা এখন আর কোথাও পিছিয়ে নেই। রাজনীতি, ব্যবসা, প্রশাসন, এমনকি সেনা ও পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও নারীরা পুরুষের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং এখন আর নারীকে পিছিয়ে পড়া অংশ বলা যাবে কিনা, তাও ভাবা দরকার। আবার নারীরা পিছিয়ে পড়া অংশ বলে সংসদে তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে যদি হয়, তাহলে সমাজের আরও যেসব পিছিয়ে পড়া অংশ, যেমন- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, দলিত––তাদের জন্য কেন সংসদে আসন সংরক্ষিত থাকবে না?

এবার অবশ্য একটি অন্যরকম ঘটনা ঘটেছে। তা হলো এবারই প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ৮ জন সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এবার তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দিয়ে শেখ হাসিনা চমক দেখাতে পারেন। যদি তা হয় তাহলে এটি সমাজে বৈষম্য নিরসন এবং পিছিয়ে পড়া অংশকে মূল ধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি ইতিহাস রচিত হবে।   জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ ২৫ বছর বাড়িয়ে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয়েছে গত বছর। ফলে আগামী ২৫ বছর অর্থাৎ এবারসহ আরও ৫টি নির্বাচনের পরে সংরক্ষিত আসনে এমপি নির্বাচন করা হবে। এই ২৫ বছরে নিশ্চয়ই দেশের নারীরা আরও এগিয়ে যাবেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের তালিকাটি নিশ্চয়ই আরও দীর্ঘ হবে। ফলে দেশের মানুষ বিশ্বাস করেন, এমন একটি অবস্থা তৈরি হবে যে, নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হবে না। বরং পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল সংখ্যক নারী সরাসরি এমপি নির্বাচিত হবেন। তবে সেজন্য নারীদের জন্য ঘর যেমন নিরাপদ করা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রকেও এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, নারী নিজেকে পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল ভাববে না। নারী নিজেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশ ভাববে না—মনোজগতে এই পরিবর্তনটাই নিজেদের বদলে দেওয়ার প্রধান হাতিয়ার।

লেখক:  সাংবাদিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn