সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের দুই তরুণ আলাদাভাবে রাজনীতির মাঠে প্রচারণা শুরু করায় নড়েচড়ে বসেছেন বড় দুই দলের অন্য প্রার্থীরা। তাঁরা হচ্ছেন হাসন রাজার পরিবারের সন্তান ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) দেওয়ান শামছুল আবেদীনের মেয়ে দেওয়ান মুনমুন আনোয়ার এবং সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরীর ছেলে ইনান ইসমাম চৌধুরী। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাঁরা মাঠে প্রচারণা শুরু করেছেন। প্রয়াত মেজর ইকবাল হোসেন চৌধুরী ছিলেন একজন সাহসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের অন্যতম তিনি। ইকবাল হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে মোশতাকের বিরুদ্ধে স্টেনগান নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন। পরে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে নিবৃত্ত করেন। এ ঘটনায় তাঁকে বিদ্রোহের অভিযোগে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রহসনমূলক বিচারের খবরে তিনি পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। পরে জেনারেল জিয়া তাঁকে গ্রেপ্তার করে নানা কূটকৌশলে রাজনীতিতে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ১৯৭৭ সালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে আবারও এমপি নির্বাচিত হন। তিনবারের এমপি ছিলেন। তিনি প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। হাওর জেলা সুনামগঞ্জে ডাক, টেলিযোগাযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হয় তাঁর হাত ধরে।
স্থানীয় নেতাদের মতে, ইকবাল হোসেনের কারণে আশির দশক থেকে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টি ত্রিমুখী নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। জাতীয় পার্টিকে সুনামগঞ্জের তৃণমূলে শক্ত সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর একক ভূমিকা রয়েছে। তাঁর বাসভবন ছিল সাধারণ নেতাকর্মীদের জন্য খোলা। জাতীয় পার্টির সেই নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকের হিসাব করে গত জাতীয় নির্বাচন ও এর আগের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়। ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক বেগম মমতাজ ইকবাল মহাজোট থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পরের বছর তিনি মারা যান। তাঁদের একমাত্র ছেলে ইনান ইসমাম গত বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে বাবা ও মায়ের দেখানো পথে রাজনীতি শুরু করেন। তাঁর পড়ালেখা শেষ হওয়ার পরই স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির হাল ধরতে তাঁকে আহ্বান জানায়। বহুখণ্ডিত জাতীয় পার্টিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে এনে দিতে প্রবীণ নেতারা সুনামগঞ্জ-৪ আসনে প্রার্থী হতে তাঁকে আহ্বান জানান। গত ১৫ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শত শত নেতাকর্মী নিয়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত করেন ইনান। এই অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আবেগঘন বক্তব্য রেখে তাঁকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ শহরে জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিয়ে দিনভর শহরে গণসংযোগ করে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন।

এদিকে নির্বাচনে ভোটব্যাংক রয়েছে মরমি সাধক হাসন রাজা পরিবারের। এই পরিবারের বড় ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামছুল আবেদীন। তাঁর মেয়ে দেওয়ান মুনমুন আনোয়ার সম্প্রতি রাজনীতির মাঠে নেমেছেন। শামসুল আবেদীন সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। পেশায় স্থপতি মুনমুন কিছুদিন ধরে তাঁর বাবা ও মাকে নিয়ে সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা দেন। হাসন রাজার পরিবার থেকে এই প্রথম কোনো নারী রাজনীতিতে সক্রিয় প্রচারণা শুরু করেছেন। মুনমুন আনোয়ার একাধিক গ্রামে এরই মধ্যে মতবিনিময় করে রাজনীতির মাঠে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি মাঠে নামার পরই তাঁর চাচা জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরিন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর বাস ভবনে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়নুল জাকেরিন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর আসন থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন। রাজনীতির মাঠে অপেক্ষাকৃত তারুণ্যের পদচারণে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি থেকে যাঁরা মনোনয়নপ্রত্যাশী তাঁরা নড়েচড়ে বসেছেন। ইনান ইসমাম জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নের বিষয়টি স্পষ্ট করলেও মুনমুন আনোয়ারের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও তাঁর বাবা ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ও ২০০৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন।

ইনান ইসমাম বলেন, ‘আমার বাবা ও মা দুজনই মুক্তিযোদ্ধা এবং এমপি ছিলেন। দেশপ্রেম ও জনসেবা তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমার বাবা খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে স্টেনগান নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন। বাবার সেই প্রতিবাদ এখনো সমসাময়িক অফিসাররা গল্প করেন। সেই প্রতিবাদ আমাকে প্রেরণা দেয়। তা ছাড়া বাবা জাতীয় পার্টিতে যোগদানের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে এই আসনকে দলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন। মা-বাবার শিক্ষা থেকেই আমি সাধারণ মানুষের সেবা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাতীয় পার্টির সাধারণ নেতাকর্মীরা যেভাবে আমাকে গ্রহণ করেছে, তাতে আমি অনুপ্রাণিত। আশা করি, দল আমাকে নিরাশ করবে না। ’ দেওয়ান মুনমুন আনোয়ারও রাজনীতিতে আসার কারণ হিসেবে তাঁর পরিবারের ঐতিহ্যকে স্বীকার করে বাবার প্রেরণার কথা জানিয়েছেন। তবে কোন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন চাইবেন—সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করতে চাননি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn