হিমাদ্রি শেখর ভদ্র-
মৌসুমের শুরুতে সেচ সংকটের কারণে সুনামগঞ্জের শনির, মাটিয়ান, হালির ও খরচার হাওরে বোরোর ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকেরা জানিয়েছেন, কোথাও কোথাও জমির মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে মরে যাচ্ছে অনেক জমির ধানের চারাও। কৃষকদের ভাষ্য, নদী খননের ফলে হাওরের পানি দ্রুত নদীতে নেমে গিয়ে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া, হাওরের জলমহাল ও ছোট ছোট জলাধার শুকিয়ে যাওয়া ও বৃষ্টিপাত না হওয়া এর জন্য দায়ী। জেলার তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরী ইউনিয়নের লোহাচুড়া গ্রামের কৃষক সুধীন মন্ডল বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়েছে। তাই কার্তিক মাসেই হাওরে পানির টান পড়েছে। বোরো ধান রোপণের সময় আসার আগের হাওরের পানি নেমে গেছে। তাই কেউ কেউ জমিতে ধানই লাগাতে পারেননি। আবার কারও কারও জমি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে পানির অভাবে।’

একই গ্রামের গয়েছ মিয়া বলেন, ‘এবছর জমিতে পানি কম থাকায় চাষ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জমিতে পানি কম থাকলে মাটি নরম হয় না। আর জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকলে দ্রুত চাষ করা যায়। এখন সারাদিন মেশিন চালিয়ে পাঁচ বিঘা জমিও চাষ করা যায় না।’ বালিজুড়ি গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘কার্তিক মাসেই জমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সেচ মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিতে হচ্ছে। এতে বোরো আবাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। পানি কম থাকায় সার-কীটনাশক বেশি লাগছে।’ আনোয়ারপুর গ্রামের হুসেন আলী জানান, জমি শুকিয়ে যাওয়ায় তিনি ধানের চারাই লাগাতে পারেননি। কিছু জমিতে হালকা পানি থাকলেও উর্বরতা কমে গেছে। তাই সার বেশি লাগছে। একই গ্রামের আলী নূর বলেন, ‘নদী খননের কারণে হাওরের পানি নেমে গেছে। ডোবার পানিও নেমে গেছে একই কারণে। এজন্য আমার জমিতে সেচ দেওয়ার মতো পানিও নাই।’

বাগগাঁও গ্রামের আনফর আলী বলেন, ‘জমিতে পানি না থাকায় ইদুরে ধানের চারা কাটছে। অন্যদিকে, জমির চারা গাছ লাল রং ধারণ করায় সার ও কীটনাশক দিতে হচ্ছে। অথচ গত বছর এ সমস্যা ছিল না।’ তিনি হাওরের অভ্যন্তরে জলাধারের সংস্কার ও নাব্যতা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। উমেদনগর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া বলেন, ‘যাদের হাতে টাকা-পয়সা আছে, তারা ছোট ছোট মেশিন কিনে জমিতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আর গরিব কৃষকদের মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই, তাই তাদের চাষবাসও নেই।’ ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনজিত চৌধুরী রাজন বলেন, ‘আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের বোরো ধান রক্ষার জন্য নদী খনন করছে। সরকার অনেকগুলো নদী একসঙ্গে খনন করায় হাওরের পানি দ্রুত নেমে গেছে। কৃষক কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের জমি শুকিয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে হাওরে স্থায়ীভাবে পানির রির্জারভার তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, হাওরের অভ্যন্তরে খাল ও নালা তৈরি করে দিতে হবে, যাতে কৃষকেরা জমিতে সেচ মেশিন দিয়ে হলেও

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আব্দুল মোন্নাফ বলেন, ‘বোরো জমিতে রোপণ থেকে শুরু করে ধানের চারা পরিপক্ক হওয়ার সময় পর্যন্ত পানি থাকতে হয়। এসময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি না থাকলে জমিতে পোকা-মাকড়ের উৎপাতসহ নানান সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য হাওরের অভ্যন্তরে সেচের জন্য আলাদা চ্যানেল তৈরি করা প্রয়োজন, যেগুলো দিয়ে রোপণ মৌসুমে জমিতে সেচ দেবেন কৃষকেরা।’ হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘হাওরের কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু বাঁধ ভর্তুকি দিয়ে কৃষক ও কৃষিকে বাঁচানো যাবে না।’ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (সেচ) সুনামগঞ্জের সহকারী প্রকৌশলী হুসাইন মুহাম্মদ খালেদুজ্জামান বলেন, ‘সুনামগঞ্জে বিএডিসির অনেক সেচ প্রকল্প চালু রয়েছে। এগুলো দিয়ে কৃষক উপকার পাচ্ছেন। বিএডিসি কৃষকদের সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত আন্তরিক। এবার হঠাৎ হাওরের পানি নেমে যাওয়ায় সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন  হাওর এলাকায় যা যা করার প্রয়োজন, তাই করবে।’
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn