অভিজিৎ হত্যা: ৭ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রস্তুত
মুক্তমনা ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। সাত জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রস্তুত করা হলেও এই হত্যার বিভিন্ন পর্যায়ে ১১ জন জড়িত ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এর বাইরে একজনের বিরুদ্ধে হত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিজিৎ হত্যায় জড়িত একজন দুই বছর আগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। জড়িত আরও তিন জনের সাংগঠনিক নাম পাওয়া গেলেও তাদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৮ জনের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, এদের মধ্যে ছয় জনকে গ্রেফতার করেছিল এলিট ফোর্স র্যাব। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম- সিটিটিসির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা এই হত্যার ঘটনায় জড়িত। হত্যাকাণ্ডে ১০-১২ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এদের বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। বাকিদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না।’
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশের ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে। এসময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও আহত হন। ওই ঘটনায় অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, অভিজিৎ হত্যা ঘটনায় এপর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলো— শফিউল ইসলাম ফারাবী, আবুল বাশার, জুলহাজ বিশ্বাস, জাফরান আল হাসান, তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী মিঠু, আমিনুল মল্লিক, আরাফাত হোসেন, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, ইয়াসিন ও মান্নান রাহী ওরফে ইয়াহিয়া। এর বাইরে একজন গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তদন্তে গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে ফারাবী, আরাফাত, সোহেল ও সায়মনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আরাফাত, সোহেল ও সায়মন নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিজিৎ রায় হত্যার মূল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিল সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, তিনি দীর্ঘ দিন ধরে পলাতক থেকে আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে জিয়া নিজেই এই হত্যাকাণ্ডের তদারক করেছিলেন বলে আরাফাত, সোহেল ও সায়মনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। জিয়াসহ এই চারজন ছাড়াও এই হত্যায় আরও ৭ জন সরাসরি অংশ নেয়। তারা হলো— মুকুল রানা, সেলিম ওরফে হাদী, আকরাম হোসেন, হাসান, অন্তু, আলী ও অনিক। সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, তারা সাত জনকে আসামি করে চার্জশিট তৈরি করেছেন। এদের মধ্যে ফারাবী, আরাফাত, সোহেল, সায়মন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। বাকিদের মধ্যে জিয়া, আকরাম ও হাসান এখনও পলাতক। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় সেলিম, অন্তু, আলী ও অনিককে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের বেশিরভাগই সাংগঠনিক নাম নিয়ে চলাফেরা করে। তাদের আসল-পরিচয় জানতে পারলে পরবর্তীতে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হবে।
কাউন্টার টেরোরিজমের কর্মকর্তারা বলছেন, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগ। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে সিটিটিসি এই মামলার তদন্ত শুরু করে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর র্যাব ২০১৫ সালের ৩ মার্চ সর্বপ্রথম শফিউর রহমান ফারাবী নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে। ফারাবী তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অভিজিৎকে হত্যার বিষয়ে একাধিক স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডে ফারাবীকে প্ররোচণাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুল এলাকা থেকে মোহাম্মদ আবুল বাশার, জুলহাজ বিশ্বাস ও জাফরান আল হাসানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এর আগে ওই বছরের ১৭ আগস্ট তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী মিঠু ও আমিনুল মল্লিককে গ্রেফতারের পর তাদের সবাইকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। কিন্তু মামলার তদন্তে ফারাবী ছাড়া বাকি ছয় জনের কারও বিরুদ্ধেই অভিজিৎ হত্যায় অংশ নেওয়ার কোনও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থাতেই অসুস্থতাজনিত কারণে আবুল বাশার মারা যায়। সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যায় গ্রেফতার হওয়া মান্নান রাহী ওরফে ইয়াহিয়াকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও অভিজিৎ হত্যায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও অসুস্থতাজনিত কারণে কারাগারেই মৃত্যু হয়েছে তারও।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ও বইমেলার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িত সন্দেহে ছয় জনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। এদের একজন শরিফুল ইসলাম ওরফে মুকুল রানা ২০১৬ সালের ১৯ জুন ভোরে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার বাঁশপট্টিতে ডিবি পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মুকুল রানা আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিল। নিহত মুকুল অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। পরবর্তীতে ২০১৭ নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সিটিটিসির কর্মকর্তারা আরাফাত হোসেন, আবু সিদ্দিক সোহেল ও মোজাম্মেল হোসেন সায়মন নামে আনসার আল ইসলামের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে আরাফাত সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছিল এবং সোহেল ও সায়মন ইন্টেল শাখার সদস্য হিসেবে রেকি করা ছাড়াও হত্যার সময় ব্যাক-আপ টিমের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিল। তাদের সঙ্গে ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিল জিয়া।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার হওয়া আরাফাত তাদের জানিয়েছে, অন্তু ও আলী অভিজিৎকে কুপিয়েছিল। অন্যদের সঙ্গে অনিক ও হাসান তাদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছিল। কিন্তু অন্তু, আলী ও অনিকের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি। এগুলো তাদের সাংগঠনিক নাম। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আসাদুল্লাহ নামে এক আনসার আল ইসলাম সদস্যের কাছ থেকে হাসানের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে। একারণে হাসানের নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই শেষে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি সম্পন্ন হলেই আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। জানতে চাইলে অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘পুলিশ চার্জশিট দিচ্ছে এটি একটি ভালো খবর। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি চার্জশিট শেষে মামলাটির যাতে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হয়ে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’ অজয় রায় বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। শরীরে নানা অসুখ দানা বেঁধেছে। আমি চাই, আমি যেন জীবিত অবস্থাতেই আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচারটা দেখে যেতে পারি। এইটুকুই আমার চাওয়া।’