অর্ধশত মিল ও ধানের আড়ৎ বন্ধ : হাওরাঞ্চলের ৫ সহস্রাধিক শ্রমিক বেকার
জিয়াউর রহমান লিটন-
হাওরের ফসলহানির পর সুনামগঞ্জের দিরাই হাওরাঞ্চলে অর্ধশত মিল ( চালকল) ও ধানের আড়ৎ বন্ধ হয়ে পড়েছে। যার ফলে ৫ সহস্রাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন, চালের বাজারে দেখা দিয়েছে আগুন। ফসল হারানোর পর থেকে চালের দাম অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান ভোক্তারা। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা প্রদান করলেও তাতে কোন প্রভাব পড়েনি চালের বাজারে। চালের বাজার ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্তসহ ফসলহারা কৃষক পড়ছেন বিপাকে। দিরাই বাজার হাওরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাজার। এ বাজারে প্রায় অর্ধশত অটো রাইসমিল ও ছোটবড় ৪০টি ধানের আড়ৎ রয়েছে। এবার বাঁধ ভেঙে চৈত্র মাসেই হাওর তলিয়ে যাওয়ায় একমুঠো ধানও কৃষকের গোলায় তুলতে পারেনি। দুর্যোগে হাওরের ধান না-উঠায় আড়ৎ ও মিল বন্ধ রয়েছে। মিল বন্ধ থাকায় কয়েল লাকড়ি উৎপাদনও বন্ধ। বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক। এদের অধিকাংশই কাজের সন্ধানে এলাকাছেড়ে শহরে পারি জমাচ্ছেন পরিবার পরিজন নিয়ে।
মিল (চালকল) মালিকরা জানান- বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ় এই তিন মাসে প্রতিটি অটোরাইসমিল ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মণ ধান ভাঙানো হত। এ অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিকটন চাল খুলনা, চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, আশুগঞ্জ, সিলেটে রপ্তানি করা হতো। এছাড়া প্রতিটি মিলে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। ধানের চোলা দিয়ে কয়েল লাকড়ি তৈরি করে বাজারজাত করা হত, লাকড়ি মিলে ও শ্রমিক কাটতো ১০-১৫ জন। ধানের আড়ৎদাররা ফড়িয়ার মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতেন, নৌকাসহ আরও ৫-৬ জন করে শ্রমিক কাটতো। ধান-চাল কেনা বেচায় ও লাকড়ি মিলে ৩ টি স্তরে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এসব শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রম বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার দরিদ্র পরিবারের জীবন জীবিকা চলতো। অনেক মিল মালিক ও ধানের আড়ৎদারগণ মৌসুমের শুরুতে আবার অনেকে মৌসুম শুরুর আগেই পুঁজি বিনোয়োগ করে থাকেন। এ বছর কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা।
মেসার্স সাকির অটো রাইছ মিল এর স্বত্ত্বাধিকারী ছাব্বির মিয়া জানান- যেখানে চাল রপ্তানি করা হত সেখান থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে ধানের উৎপাদন না থাকায় মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি গত বছর ৩০-৪০ হাজার মণ চাল রপ্তানি করেছি, লাকড়ি আরও ৮-১০ হাজার মণ বিক্রি করেছি, মিল বন্ধ থাকায় প্রায় ২০ জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ঋণ জটিলতা ও বিদ্যুৎ ভোগান্তি না-থাকলে অনেক ব্যবসায়ী উদ্যেক্তা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারতো। দুর্যোগের কারণে মিল বন্ধ কিন্তু মিল বন্ধ থাকলেও ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। দুর্যোগে মিলবন্ধকালীন সময়ে বিদ্যুৎ বিল মওকুফের দাবি জানানো হয়। খুচরা কারবারীরা বলছেন- এলাকায় দিনমজুর সংখ্যা কমে গেছে, অনেক শ্রমিক এলাকা ছাড়া; সরকারি সহায়তার কারণে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে চালের খুচরা বাজার।
মিল মালিক সাইফুল ইসলাম জানান- যে মৌসুমে হাজার হাজার মণ চাল যেখানে রপ্তানি করা হত বর্তমানে সেখান থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে, উৎপাদনও শূন্য; যার কারণে দাম বাড়ছে। এবার চাল আমদানি করার কথা ভাবছি, তবে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকবে বলে তিনি মনে করেন। স্থানীয়রা জানান- গত বৈশাখ মৌসুমে যেখানে ধানের দর ৫শ’ টাকা এবং চাল প্রতি ৫০ কেজি বস্তা ৯শ’ টাকা থেকে ১১শ’ টাকা ছিল। কৃষক ফসল হারানোর পর বৈশাখ মৌসুমে ১৮৫০ টাকা থেকে ২৭০০ টাকা দর চাল বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না। গত মৌসুমে লাকড়ির মণ যেখানে ছিল ১৭০-২০০ টাকা, বর্তমানে ৫০০ টাকারও উপরে।
মিল মালিক কামাল উদ্দিন বলেন- গত বৈশাখ মাসেই ধান ভাঙিয়ে ৫-৭ হাজার মণ চাল বিক্রি করেছি, ধানও বিক্রি করছি আরও ৫-৭ হাজার মণ। যেখানে ৯০০-১১০০ টাকা এখন এই চাল কিনতে হচ্ছে ২১০০-২১৫০ টাকায়। ধান না-উঠায় ৪৪টি লাইসেন্সকৃত মিল বন্ধ রয়েছে। প্রতি মাসে কয়েল লাকড়ি ৫শ’ মণ বিক্রি করেছি। মিলের ম্যানেজার, ড্রাইভারসহ ১৫-২০ শ্রমিক বেকার। এই শ্রমিকের উপর ২০টি পরিবার চলতো। খুলনা, চিটাগাং, রাজশাহী, চাঁদপুর রপ্তানি করা হত। অনেক ব্যাপারীর কাছে দেনা থাকলেও তাও পাওয়া যাচ্ছে না।
ওয়ারিছ অটো রাইসমিলের মালিক মঞ্জু মিয়া জানান- মৌসুমে তিনি ৫০-৬০ হাজার মণ ধান সংগ্রহ করে থাকেন। ধান সংগ্রহে তিনি ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। তার মিলে ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। ১৫-২০ হাজার মণ কয়েল লাকড়ি তৈরি করে বিক্রি করতেন। বৈশাখ মৌসুমে ১০০০-১১০০ টাকা দর থাকতো বর্তমানে ২১০০-২৪০০ টাকা। ধান ব্যবসায়ী পরেশ তালুকদার জানান- গত মৌসুমে তিনি ৫৫ হাজার মণ ধান ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করছেন, এবার তিনি একমুঠো ধানও কিনতে পারেননি। শ্রমিকরা বেকার ৫টি ঘরে ৩শ’ জন শ্রমিক কাজ করছেন, ঘরভাড়া দিয়ে চলাই দায় পড়েছে।
স্থানীয় সাংসদ ড. জয়া সেনগুপ্ত বলেন- হাওরপাড়ের মহাদুর্যোগে আমরা মর্মাহত। এ দুর্যোগ উত্তোরণে সরকার বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উপজেলায় ১৬ হাজার ৩শ’ জনকে ৩৮ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ফেয়ার প্রাইজ ৯ হাজার, ভিজিডি ৮ হাজারসহ মোট ৩৫ হাজার পরিবারকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সবসময় পাশে থাকবো উল্লেখ করে তিনি বলেন- ত্রাণ বিতরণে সুসম বণ্টন নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া আছে। এতে কোন ধরনের অনিয়ম মেনে নেয়া যাবে না। এছাড়া নয়টি ইউনিয়নে ৯ জন ও পৌরসভায় ১০ জন ডিলারের মাধ্যমে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করা হচ্ছে।