অহংকার নয় আওয়ামী লীগে এখন আত্মসমালোচনার সময়
পীর হাবিবুর রহমান-আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের এখন ক্ষমতা গর্বিত আত্মতৃপ্তি আত্মঅহংকার নয়, আত্মসমালোচনা আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি অনিবার্য। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি ক্ষমতায় টানা এক যুগ পূর্ণ করে নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির ১৫ বছরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তি এতটা সময় এভাবে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এমনকি উপমহাদেশেও কংগ্রেস ছাড়া কারও এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার নজির নেই। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেসের দীর্ঘ ক্ষমতার রেকর্ড ভঙ্গ করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চলছে। ক্ষমতায় থাকার এমন কৌশল শেখ হাসিনাই জানেন। যদিও ভারতের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্রপট অনেক বদলে গেছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের রাষ্ট্রীয়ভাবে সংঘটিত অপরাধ তাদের রাজনীতিকেই দেউলিয়া করেনি, কোমর সোজা করে মাঠের বা ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে আর দাঁড়াতে দেয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দলের এ শূন্যতার ভিতর দিয়েই শেখ হাসিনার সরকার যে টানা ১৫ বছরের মেয়াদ পূর্তি করে আরেক টার্ম ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে তা বলা যায়। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার শাসনকালে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে একুশের ভয়ংকর গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে নেতাদেরসহ উড়িয়ে দিতে গিয়ে রাজনীতিকে বীভৎস রকমের রক্তাক্ত, বেদনার্ত ও অভিশপ্ত করেছিল। ’৯০-উত্তর গণতন্ত্রের যাত্রাপথের সমঝোতার সংস্কৃতিকে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল। সেই পাপ যারা করেছিলেন তারা দন্ডিত হলেও রাজনৈতিকভাবে বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলে ধসই নামায়নি, পঙ্গুই করেনি, নিবেদিতপ্রাণ ইতিবাচক রাজনীতির নেতা-কর্মীদেরও চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ওয়ান-ইলেভেনের জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শাসনকাল সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা মুছে ফেলার সুযোগ করে দেয়। বিএনপি এখন কার্যত নেতৃত্বহীন গৃহবন্দী ভঙ্গুর এক দলে পরিণত হয়েছে, যে দলের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অধীনে ভোটযুদ্ধে সুবিধা ও গণআন্দোলন গড়ার কোনো শক্তি-সামর্থ্য নেই। এমনকি কার্যত বন্দী খালেদা জিয়ার পক্ষেও শক্তি ক্ষয় করে মামলার জালে আটকা বিএনপিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ নেই। দন্ডিত তারেক রহমান নির্বাসিত। বেগম খালেদা জিয়াও শারীরিকভাবে অসুস্থ। বিএনপি নেতাদের বিবৃতি আর ব্রিফিং করে অস্তিত্ব জানান দেওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। দলে অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও রণকৌশল নির্ধারণ করে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতাও তাদের হাতে নেই। অথচ এদেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নিয়ে দলকে একটা জায়গায় আনার কথা। আওয়ামী লীগ ২১ বছর টানা ক্ষমতার বাইরে ছিল। বিএনপি ১৪ বছর।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভঙ্গুর হলেও শক্তিশালী সরকারের বিপরীতে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রয়োজন। সেখানেও বিএনপি হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে হারিয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরের বিএনপি আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরের বিএনপিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সংখ্যায় সংসদে কম হলেও খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতার আসন নিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানেরই জানান দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন, জামায়াতকে না ছাড়া, হেফাজতের তা-বকে সমর্থন করে সরকার হটানোর মতো ভ্রান্ত পথ, সর্বশেষ ২০১৮ সালের সার্কাস ঐক্যে ফল আনতেই পারেনি। আর তখন খালেদা জিয়া কারাবন্দী-দন্ডিত ও নির্বাচনের বাইরে। নির্বাচন কমিশন ও ভোট নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ না করলে বিএনপির আসন বাড়ত কিন্তু সরকার গঠনের মতো বিজয়ের ধারেকাছে যাওয়ার শক্তি বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না ভোটযুদ্ধে। বিএনপি দলকেও গোছাতে পারেনি। সংসদে এখন সাতজন, কথা বলছেন দুজন। সরকারি দলের জন্যও এমন বিরোধী দল সুখের নয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে খুনিদের শাসন থেকে সামরিক শাসনের টানা ২১ বছর অন্ধকারে ছিল দেশ। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকেই হত্যা করা হয়নি, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। দেশছাড়া করে স্বৈরশাসনের মাধ্যমে বিচারহীনতা, খুনিদের পুরস্কৃত করা, পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি যা ’৭১ সালে পরাজিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে, তা ফিরিয়ে এনে দমন ও প্রহসনের নির্বাচন চালু করা হয়। মিডিয়া ক্যু, কেন্দ্র দখল গণরায় ছিনতাইয়ের ভোটের অভিশাপ নেমেছিল দেশে। সেই দুঃসময়েও আওয়ামী লীগের আদর্শিক গণমুখী নেতা-কর্মী থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ’৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট ও ’৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনকেও বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। বৈরী সময়ে রণকৌশল নির্ধারণে দল ভুল করেনি। ’৭৫-উত্তর আওয়ামী লীগ একদিকে সেনাশাসক অন্যদিকে প্রতিবিপ্লবী ও উগ্রপন্থিদের অপপ্রচারেরও শিকার হয়েছে। মিত্ররাও সেনাশাসক জিয়ার খাল কাটা বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র তো পুরো ব্যবহার হয়েছিলই। ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়তো প্রকৃতি এমন করেই নেয় যা জনগণ না চাইলেও। তাই সেই বিএনপি আজকের রাজনীতিতে এতটাই নিয়তির শাস্তি ভোগ করছে। অথচ আওয়ামী লীগের একটি অংশ আজ শিক্ষা নিতে নারাজ।
’৮১ সালে আওয়ামী লীগের ইডেন কাউন্সিলে দলের প্রয়োজনে জাতির ক্রান্তিকালে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দিল্লি নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা ছিল অনিবার্য। তিনি ফিরে এসে অসীম সাহসিকতায় জীবনের ৪০ বছর লড়েছেন। দলের ভাঙা-গড়ার অবসান ঘটিয়ে নেতা-কর্মীকে এক কাতারে এনেছেন ঐক্যের মোহনায়। দলকে আন্দোলনের পথে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও দমে না গিয়ে জনপ্রিয় করেছেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়েছেন। সব রণকৌশল নিয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে তোলা আন্দোলনেও তার কর্মী-সমর্থকদের দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতায় বিস্ফোরণ ঘটাতে দিয়েছেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬ সালে দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্নই শুধু করেননি সুশাসনে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়েছেন। তিনিই সংসদে ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্র্যাসির ধারায় প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব, মন্ত্রীর বদলে সদস্যদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের কাছে পরাজিত হলেও ফলাফল ছিল বিস্ময়ের। এ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলা যে পর্দার আড়ালে ছিল সেটি নিয়েও পরে অনেক কথা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলেও নেতা-কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন নেমেছিল সে ইতিহাসও সবার জানা। পরে ফের শেখ হাসিনা প্রথমে ১৪ দল ও পরে মহাজোট গঠন করে আন্দোলনের পথে ভোটযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হলে বিএনপি জোট তাদের ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় ফিরতে চাইলে রাজনীতি সংঘাতে গড়ায়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ওয়ান-ইলেভেন ব্যাপক গণসমর্থন নিয়ে এলেও সেনাসমর্থিত সেই সরকারের ভ্রান্তনীতি, দমন-পীড়নে প্রতিবাদী শেখ হাসিনাকেই প্রথম জেলে যেতে হয়। পরে বেগম খালেদা জিয়াকে। ব্যবসায়ীসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দেশছাড়া করে কর্তৃত্ববাদী অগোছালো কর্মকা-ে গণঅসন্তোষে তাদেরও নেত্রীদের মুক্তি ও নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে হয়। ওয়ান-ইলেভেনে দেশের রাজনীতিতে এক রহস্যময় চিত্রনাট্য হয়ে আছে। কত দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ সিভিল সোসাইটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ক্ষত তৈরি করে গেছেন। সেসব ইতিহাস সবার জানা। সেই ২০০৮ সালে বিশাল বিজয় নিয়ে শেখ হাসিনার মহাজোট ক্ষমতায় এসেছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে বিচারে। শেখ হাসিনা দেশকে বিস্ময়কর উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়েছেন। বিশ্বমোড়লদের রক্তচক্ষুও আমলে নেননি। হরতাল-অবরোধমুক্ত বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা অকুণ্ঠ সমর্থন করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে গণমাধ্যম যে সমর্থন দিয়েছে এমনটি বঙ্গবন্ধু সরকারও পায়নি। পশ্চিমা দুনিয়াও তারিফ করতে ভোলে না। অর্থনীতিতে ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়ায় দেশকে উন্নয়নের মডেলে নিয়ে নিজেও বিশ্বনেতাদের পাশে আসন পেতেছেন। আরেক টার্ম ক্ষমতায় এলে বিএনপির পরিণতি কী হবে এ নিয়ে পর্যবেক্ষকদের নানা কথা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার ইমেজের ওপর আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে। তিনি ও দেশ যতটা এগিয়েছে আওয়ামী লীগ কি বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার দর্শনে গণমুখী আদর্শিক নেতৃত্বের ওপর ভর করে সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে? দলের অনেক মন্ত্রী, এমপি, নেতার আত্ম অহমিকায় মনে হয় যেন তারা যা-ই করুন সাত খুন মাফ। কারণ শেখ হাসিনাই তাদের ক্ষমতায় রাখবেন। তাদের নৌকা প্রতীক জুটলেই জয়! তারা ভুলেই গেছেন এই দিনই শেষ নয়। ভুলে গেছেন তাদের বিরোধী দলে থাকার যন্ত্রণার দগদগে ঘা। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় কথাটি। গণঅসন্তোষ শব্দটি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলতে মানুষ লজ্জা পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের একাংশের যে কোনো নির্বাচনেই বিশাল ভোটে বিজয়ের বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে যে দৃশ্য জনগণকে দিয়েছেন তা আওয়ামী লীগের মতো দলে মানায় না। ক্ষমতা তাদের অন্ধ করে দিয়েছে। হুঁশ বুদ্ধি হারিয়ে বেহুঁশ। শেখ হাসিনা যদিও বারবার দলকে নতুন নেতৃত্ব বের করার তাগিদ দিয়ে অবসরে যাওয়ার কথা বলেন ততই সামনে আসে আওয়ামী লীগই নয়, এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। বয়স ৭৪ হলেও আল্লাহর রহমতে বারবার মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এলেও শারীরিকভাবে এখনো তিনি ফিট। পরিশ্রমী। ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি দল ও নেতা-কর্মীদের নিয়ে সজাগ সম্পৃক্ত থাকার বিরল ক্যারিশমার অধিকারী। কিন্তু তিনি যে গতিতে যে আদর্শে ছুটছেন, যে অঙ্গীকারে মানুষকে জয় করছেন দলের নেতা-এমপিরা কি সে পথে সবাই ছুটছেন! বসুরহাট পৌরসভার আবার নির্বাচিত মেয়র বহুল আলোচিত মির্জা কাদের এক মাস ধরে দলের মধ্যে অনেকের বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই হলেও দলের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া কর্মী। বিরোধী দলে থাকতে অনেক নির্যাতনও ভোগ করেছেন। তার অনেক কথা দলের অগণিত নেতা-কর্মীরও মনের কথা। কিন্তু তিনি তার এলাকার বাইরে গিয়ে অনেকের নাম নিয়ে যেভাবে কথা বলছেন তাতে বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরকে বিব্রত করছেন। ওবায়দুল কাদের অসুস্থ শরীর নিয়েও দল ও সরকারে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। ’৬৯-এর উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উঠে আসা মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুল কাদেরও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আজকের জায়গায়।
’৭৫-পরবর্তীতে কারাগারে বসে ছাত্রলীগ সভাপতি হন। নেত্রী ও দলের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়েই তাকে এখানে আসতে হয়েছে। মির্জা কাদের বিরতিহীনভাবে এভাবে বললে মিডিয়া ক্রেজে আক্রান্ত হবেন। কিন্তু তার মতো নিবেদিতপ্রাণ সৎ কর্মীর বিরুদ্ধে দল শৃঙ্খলাভঙ্গের ব্যবস্থা নিলে মিডিয়াও আর খোঁজ নেবে না। এটা বোঝা উচিত। তিনি দলের ফোরামে কথা বলতে পারেন। আওয়ামী লীগের একটি বর্ধিত সভা অনিবার্য, সংসদ সদস্যদের আমলনামা শেখ হাসিনার হাতে আছে। সবই তাঁর নখদর্পণে। যেসব এমপি, কেন্দ্রীয় বা মাঠ নেতা অপকর্ম করছেন তাদের সতর্ক করার সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। একটি বাগান নষ্টের জন্য একটি বানরই যথেষ্ট। দলের যেসব এমপি, মাঠ নেতা সিন্ডিকেট করে রাজনীতিকে মানুষের সেবা থেকে বাণিজ্যিক কর্মকা-ে জড়িয়েছেন, নিজেদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ, আখের গোছাচ্ছেন, দলকে পারিবারিক, ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছেন, নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে হাট মাঠ ঘাট থেকে ঠিকদারি নিয়ন্ত্রণ, কমিশন-বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা করছেন তাদের ভয়ে কেউ কথা বলছে না হয়তো কিন্তু দলের সমর্থক-কর্মীরা অসন্তোষের অনলে পুড়ছেন। মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিজয় এসব অসন্তোষের ফসল। কর্তৃত্ববাদীদের দলাদলি কোন্দলের চরম বহিঃপ্রকাশ। এটা বুঝতে হবে। দেশকে এত উন্নয়নের স্বর্ণযুগে শেখ হাসিনা নেওয়ার পর, ৯ লাখ গৃহহীনকে গৃহদানের টার্গেট নিয়ে ৭০ হাজারকে গৃহদান করেছেন। করোনার বিপর্যয়ে যেখানে অনেক শক্তিমান মুখ থুবড়ে পড়েছেন সেখানে দেশের অর্থনীতি-জীবন-জীবিকা রক্ষায় সফলতা দেখালেও কারও কারওর অপকর্ম গণঅসন্তোষ বাড়ায়। কৃষিতে, প্রযুক্তিতে, বিদ্যুতে, যোগাযোগে দেশে বিপ্লব ঘটছে। করোনার টিকা মানুষের হাতে। সম্প্রতি যশোরে দলের নেতা ও এমপি শাহীন চাকলাদারের থানার ওসির সঙ্গে ক্ষমতার দম্ভের টেলিকথোপকথন প্রকাশ হয়েছে। হাই কোর্টের নির্দেশ নয়, তার কথাই শেষ কথা বলেছেন ওসিকে। কীভাবে একজন মানুষকে ঘটনা ঘটিয়ে মামলায় ফেলা যায় সেটি শিখিয়ে দিচ্ছেন এমপি ও দলের নেতা শাহীন চাকলাদার। এমন আওয়ামী লীগ এমপি-নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হন কীভাবে? শেখ হাসিনার পথের সাথী হন কেমন করে? বঙ্গবন্ধু যেভাবে আত্মসমালোচনা-আত্মশুদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন কতভাবে বুঝিয়েছেন তেমনি শেখ হাসিনা বারবার সতর্ক করলেও একদল এমপি-নেতা বেপরোয়া। নেত্রীর ইমেজ, দলের স্বার্থ নয়, নিজেদের দম্ভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ভোগবিলাস আর বাণিজ্যই বড়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে হাজার হাজার নেতা-কর্মী পোড় খাওয়া। অনাদর অবহেলায় আছেন। আদর্শিক, ত্যাগের মনোভাব। এখনো অনেক সময় আছে তাদের দলের কাজে লাগানোর। শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত দলের জন্য নিবেদিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য অনেকে অতীতে ভূমিকা রেখেছেন সাহসের সঙ্গে। দলের ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনা সেসব ছিটকে যাওয়া নেতাকে কাজে লাগাতে পারেন। কাল শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে যারা অপকর্ম করছেন তারা দেশ ছেড়ে পালাবেন আর বিপর্যয়টা অগণিত নেতা-কর্মীর কাঁধে ফেলবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে শক্তি সমর্থন দিচ্ছে তারা বিপদে পড়বেন। দলের নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত ঐক্যবদ্ধ করে মানুষের হৃদয় জয় করে চলতে হলে আদর্শিক গণমুখী নেতৃত্বের বিকল্প নেই। ভোগবাদী লোভ-লালসায় রাজনৈতিক পদবিকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে অর্থ-বাণিজ্য কামানোর ধারায় যারা ডুবেছে সে মাঠের যত বড় নেতাই হোক, এমপি হোক তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনাকেই কঠোর হতে হবে। মাঠের বদদের সরিয়ে দল সাজাতে না পারলে শেখ হাসিনার উন্নয়নের ইতিহাস লেখা থাকলেও দলকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে। এ ছাড়া দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সুবিধাবাদীদের যে ভিড়, রাতারাতি খালেদা জিয়া-তারেক রহমান ছাড়া সবাই যেভাবে বড় আওয়ামী লীগ সব শ্রেণি-পেশায় দৃশ্যমান এটা ভয়ংকর। ব্যাংক ডাকাত, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজরা আওয়ামী লীগের সমর্থন পেতে পারে না। এরা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু। ক্যান্সারের মতো আদর্শহীনরা লুটের ভাইরাস ছড়িয়েছে। এসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অপারেশন আরও জোরদার করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দলের লাগামহীন মাঠ নেতা, এমপিদের লাগাম টেনে ধরা। একেক এলাকায় একজন কী করছেন মানুষ দেখছে। যেন বারো ভূঁইয়ার শাসন! মানুষ জানছে, ক্ষোভে ফুঁসছে। শেখ হাসিনার ইমেজ, আর আওয়ামী লীগের ইমেজে কতটা পার্থক্য এটা বিশ্লেষণ করার সময়। আওয়ামী লীগই একমাত্র গণসম্পৃক্ত মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারত্ব বহন করা দল। ১২ বছরে দলের ভিতরে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া কারা অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক হলেন? কারা এসে ভর করে খেয়ে যাচ্ছেন মধু? এদের চেহারা মানুষ দেখে, দল তো দেখে না। বিএনপি জমানায়ও অনেকে বিএনপি হয়ে আখের গোছান। কত শান-শওকত, শোডাউন! আজ দুরবিন দিয়ে খুঁজে পায় না তারা। শেখ হাসিনার লক্ষ্য অর্জনের সাফল্যকে দল যদি পুঁজি করতে চায় রাজনীতিতে তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র বা হাইব্রিড নয়, বিতর্কিতদের নয়, আদর্শিক গণমুখী নেতৃত্বেই রাজনৈতিক শক্তিতে জনগণের মন জয় করে অগ্রসর হতে হবে। এ জন্য আত্মসমালোচনা-আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি ঘটাতে শুদ্ধি অভিযান অনিবার্য। ওবায়দুল কাদের ’৭৫-পরবর্তী ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের অভিভাবক ছিলেন। সারা দেশের সংগঠকদের চেনেন। তার পরবর্তী সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে এদের মধ্য থেকে যারা দলের কোথাও নেই সেই দক্ষ সংগঠকদের এনে কাজে লাগাতে পারেন। শেখ হাসিনা সারা দেশের দলের খবর রাখেন। তিনি দলটাকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে আনতে কঠোর হতে পারেন। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তৃণমূলে যেতে হবে। করপোরেট বাণিজ্যিক ভবন দলের মনোনয়নের ও পদবি নির্ধারণ করলে দল থাকে না। সংসদে এমনিতেই রাজনীতিবিদ কমেছে। রাজনীতির বাইরে থাকা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে। এটা রাজনীতির জন্য শুভ নয়। করপোরেট কর্তৃত্ব দলের মধ্যে সুখকর হবে না। এরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগকেই করপোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বানাতে চায়। বঙ্গবন্ধুর রক্তে গড়া আওয়ামী লীগ এ দেশের জন্ম দিয়েছে। গণমুখী গরিবের স্বার্থ রক্ষার দল আওয়ামী লীগ। সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্য থাকা উচিত নয়। এমনটা হতে পারে না। আওয়ামী লীগের নিয়তিটাই এমন। যখন বিরোধী দলে থাকে তখন পোড় খাওয়া নেতা-কর্মী এক পরিবার হয়ে নির্যাতন ভোগ করে। জীবন দেয়, জেল খাটে, মামলা খায়, মার খায়, লড়াই করে। দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন দুঃসময়ে শেখ হাসিনার পাশে থাকাসহ তৃণমূলের অনেকে ছিটকে যায়। বড় অভিমানে পোড়ে। আর সুবিধাবাদী এবং আমদানি পার্টি এসে দখল নিয়ে পুরো ক্ষমতার স্বাদ নেয়। আজ দলকে পুরোটাই ভাববার সময়। পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।