বার্তা ডেস্ক :: প্রায় আট বছর ধরে কোমায় আছেন বাউলশিল্পী হাছন রাজার বংশধর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা। গত ১২ অক্টোবর ছিল তার চাকরির মেয়াদের শেষ দিন। সেই দিনটি এক অভাবনীয় আনন্দের ক্ষণ বয়ে আনে তার পরিবারের জন্য। গর্বিত করে তাঁর সেনাজীবনকে। কোমায় থাকা তাছাওয়ারকে কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয় সেনা কর্তৃপক্ষ। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) ৩১৪ নম্বর কেবিন নন্দকুজায় চিকিৎসাধীন লে. কর্নেল তাছাওয়ারকে কর্নেল ব্যাচ পরিয়ে দেওয়া হয় সেদিন। এ ঘটনা কোনো দেশের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল বলে জানা গেছে। কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা বিখ্যাত মরমী সাধক হাসন রাজার প্রপৌত্র। সিলেট ক্যাডেট কলেজের (SCC) প্রাক্তন ক্যাডেট তিনি।  তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন। যখন সুস্থ ছিলেন, তখন বাহিনীতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্বপালন ও বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখায় তাকে এই সম্মানে ভূষিত করেছে সেনাবাহিনী।
২০১৩ সালের ১১ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হন মরমী শিল্পী হাছন রাজার বংশধর দেওয়ান তাছওয়ার। এরপর গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি আট বছর ধরে সিএমএইচে আছেন। তাকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে চেষ্টার কমতি নেই চিকিৎসকদের। এরই মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ করে তাকে বিদেশেও পাঠিয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি দেওয়ান তাছাওয়ার। চিকিৎসা ভাষায় তার অসুস্থতাটা হলো ‘হাইপোস্কিক স্মিমিক ইনজুরি টু ব্রেইন ইফেক্টস’। তার হার্টের কার‌্যকারিতা ফিরে এসেছে, কিন্তু ব্রেইনের পুরোপুরি ফিরে আসেনি। তার ব্রেইনের নিচের অংশ ভালো। প্রিয় মানুষটির চেতনা ফিরে আসার দীর্ঘ ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় তার স্ত্রী মোসলেহা মুনিরা রাজা, ছেলেমেয়ে ও সহকর্মীরা। এর মধ্যে এমন পদোন্নতির ঘটনা সবার চোখে আনন্দের জল এনে দেয়। কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আবদ্ধ করে সবাইকে। ২০১৩ সালের ১২ মে থেকে সিএমএইচের হাসপাতালের বিছানাতে কোমায় আছেন কর্নেল তাছাওয়ার রাজা। এই বিছানাতেই ১২ অক্টোবর সেনা পোশাকে কর্নেল ব্যাচ পরিয়ে দেওয়া হলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপ্লুত তার সহকর্মী ও দেশবাসী। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে চাকরিজীবনের শেষ দিনে তাছাওয়ার রাজাকে পদোন্নতি দিয়ে এক বিরল সম্মানে ভূষিত করেন সেনাবাহিনী-প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
আইএসপিআর জানায়, তাছাওয়ারের ৩১ বছর ৩ মাস চাকরিজীবনের সমাপ্তি ঘটল এই পদোন্নতির মধ্য দিয়ে। ‘কিং অব দ্য ব্যাটেল’ বা সাঁজোয়া কোরের এই চৌকস কর্মকর্তার ছিল বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। প্রশিক্ষক, অধিনায়ক হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার রয়েছে গবেষক ও লেখক হিসেবে খ্যাতি। সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন সদালাপী, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য কর্মকর্তা। চাকরিজীবনে দেশ-বিদেশে ‘স্টাফ কোর্স’সহ সম্পন্ন করেছেন বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ। ১৯৮৯ সালে ২০তম লং কোর্সের সঙ্গে সাঁজোয়া কোরে কমিশন লাভ করেন দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা। তিনটি সাঁজোয়া রেজিমেন্টে বিভিন্ন পদে চাকরিসহ ঘাটাইল সেনানিবাসে একটি রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার অধীন ইউনিটটি ২০০৮ সালে ডিভিশনে সেরা ইউনিট হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এ ছাড়া ‘আর্মার্ড স্কুল’ ও ‘পদাতিক স্কুলের’ (এসআইএন্ডটি) রণকৌশল প্রশিক্ষক ছিলেন দেওয়ান তাছাওয়ার। প্রশিক্ষক হিসেবেও তার ছিল বিশেষ খ্যাতি।
কর্নেল তাছাওয়ার রাজা ইরাক, কুয়েতে শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ অবদানের জন্য ‘পিস মেডেলে’ ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান স্টাফ কলেজ সম্পন্ন করেন এবং চায়না-আমেরিকা থেকে সাঁজোয়া যানের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। এ ছাড়া তিনি মিরপুর স্টাফ কলেজের একজন গ্র্যাজুয়েট এবং সেখানকার প্রশিক্ষক হন। একজন সাহিত্যমনা সেনা কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল তাছাওয়ার রাজা। বাউলশিল্পী হাছন রাজার এই বংশধর কর্মজীবনে লিখেছেন একাধিক বই। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো ‘হাছন রাজা’, ‘জেনারেল ওসমানি: কর্নেল মাই কর্নেল’, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ইতিহাস’। এই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী মুনিরা রাজা বলেন, তাছাওয়ার রাজাকে তার কর্মের যোগ্য প্রতিদান দিয়েছে সেনাবাহিনী, যা আমাদের আজীবন কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আবদ্ধ করে রাখবে। তাছাওয়ার রাজার এই পদোন্নতির সিদ্ধান্ত সেনাপ্রধানের এক মহানুভবতার পরিচয় বলে মন্তব্য করে মুনিরা রাজা বলেন, ‘এমন ঘটনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করল। আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি মাননীয় সেনাপ্রধান আমার স্বামীকে এমন সম্মান দেবেন। এ সম্মানে আমরা গর্বিত। বিদায়বেলায় প্রত্যাশার চেয়ে এটি অনেক বড় এক অর্জন।’
সিএমএইচের আইসিইউ-প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ মজুমদার জানান, কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজার অসুস্থতাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ‘হাইপোস্কিক স্মিমিক ইনজুরি টু ব্রেইন ইফেক্টস’। ওনার (দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা) হার্টের কার‌্যকারিতা ফিরে এসেছে, কিন্তু ব্রেইনের ফিরে আসেনি। পুরো প্রক্রিয়ার সময় তার ব্রেইনে সার্কুলেশন ৫ মিনিটের অতিরিক্ত ছিল, কিন্তু ১৫ মিনিটের কম ছিল। এ জন্য তার ব্রেইনের নিচের অংশ ভালো। কিন্তু যে অংশগুলো আমাদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে জড়িত, সেই এরিয়ার সেলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়নি। এ জন্য জীবন চালানোর জন্য বেসিক বডির প্রটেকটিভ সিস্টেম ভালো থাকলেও হাইয়ার সাইকোলজিক্যাল ফাংশনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাওয়ার রাজার পরিবার সিএমএইচের চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তার স্ত্রী বলেন, ‘সিএমএইচে যখন যে ধরনের সহায়তা চেয়েছি, আল্লাহর রহমতে সব পেয়েছি। প্রায় ৮ বছর ধরে এক কঠিন সংগ্রাম করে চলেছি আমরা।’- ঢাকা টাইমস

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn