আলোর মর্যাদা
মামনি হুইল চেয়ারে বসা। হাসপাতালের কেবিনে। ঢুকেই হম্বিতম্বি শুরু করলাম, মামনি, তোমাকে কি টিপ ছাড়া মানায়? অনেক রঙ, আল্পনা আঁকা বড় টিপ, গলায় কাটুম-কুটুম শিল্পের মালা, সবার দিকে স্নেহের নজর–আর চলনেবলনে ৭১-এর দৃপ্ত মুক্তিযোদ্বার সাহস, এটাই তো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী প্যাকেজ। মামনি (মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর এ মহিমাময় মানুষটি, আমাদের অনেকেরই মামনি) একটু চোখে হাসলেন। হাসিতে সায় আছে, লাইও আছে। আমি ফট করে বললাম, দাঁড়াও আমার ব্যাগে টিপ আছে। পরিয়ে দিতেই, সেই চেনা-জানা অভ্যস্ত মানুষটি যেন আমাদের কাছে ফিরে এলেন। কারু তিতাস, তূর্য্য ও আমি মামনিকে মাঝে রেখেই রাগ-ক্ষোভের আড্ডা মারছি। এই মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর, গত দু’মাস ধরে ভুগছেন। কখনও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ, কখনও ল্যাবএইড। সত্তুরোর্ধ্ব এই মায়ের নানান শারীরিক জটিলতা। যতক্ষণ হুঁশে থাকেন, ততক্ষণ তার মাথায় কাজ করে চিকিৎসা খরচ, সমন্বয়, ছেলে-মেয়েদের আবারও ঠিকঠাক নিজেদের ব্যস্ত জীবনে ফেরানো। আবারও তার গাছের গুঁড়ির রূপের খনি কেটে কাটুম-কুটুম ভাস্কর্যের জীবন। জীবন থেকে জীবিকা। যা তিনি করছেন দীর্ঘকাল, লড়ছেন একাই। লড়াকু এই মায়ের সন্তানসম আমরা দু’দিনের বৈরাগি! হঠাৎ গিয়ে আহ্ উহ্ করি, ইস্ ইস্ করি। কী কষ্ট কী কষ্ট! এসব আওড়াই ছলছল চোখে, অথবা লিপ সার্ভিসে বলি, তোমাদের মতো বীর মায়ের জন্যই তো আজ আমরা স্বাধীন। তারপরই হয়তো চলে যাই যৌবন-নৃত্যের ইশারায় গলা দিতে! মায়েরা বোঝেন এসব এবং মুচকি হাসেন। বোধের ‘তল’বোঝার অক্ষমতা দেখে। কোনও কোনও মা অবশ্য সান্ত্বনা দেন এই বলে–যখন মা হবি, বুঝবি। আসলে মিন করেন ম্যাচুরিটির। এই মা হওয়া মানে সন্তান জন্ম দেওয়া নয়, এটা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার গভীরের আলো সঞ্চয়। যেটা মানবজনমে বেশিরভাগেরই হয় না।
প্রিয়ভাষিণীতনয় তূর্য্য একটু ‘সরলভাষী’। সরল কথাই বোধহয় জোরে শোনায়। ও মায়েদের বিশেষ করে প্রিয়ভাষিণী, বা রমা চৌধুরীর মতো মায়েদের আলো বিন্দুর কথা বলছিল। চট্টগ্রামের এই বীর মা, তিনিও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার চিকিৎসা সমন্বয় নিয়েও রমা চৌধুরীর বুকে ধরা ছেলে আলাউদ্দিন খোকন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। কারণ ওই একটাই–আলোর মর্যাদা। একাত্তরে বোয়ালখালীর রমা চৌধুরীর ওপর পাকবাহিনী বীভৎস নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়ার যুৎসই অনুভবের ভাষা আমাদের নেই। ফ্যাক্ট হিসেবে শুধু দু’লাইন বলতে পারি। রাতভর পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের ঘেন্নায় রমা চৌধুরী ভোরে বাড়ির পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আত্মহত্যার জন্য। আগুনে পোড়া বাড়ির উঠানে হামাগুড়ি দিয়ে দুধের সন্তান জহর দুধ খেতে চাইছিল। গ্রামের কোনও এক বৃদ্ধা জলে ভাসা রমাকে বলেছিল–বাচ্চাটারে দুধ দে, তারপর মর।
রমার এক ছেলে মারা গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ডিপথেরিয়ায়। মৃত্যুর সময় ওই বাচ্চা ছেলের শেষ উচ্চারণ ছিল–‘জয় বাংলা’! রমা ‘জয় বাংলা’য় আরও দুই সন্তান নিয়ে জীবনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। বাংলায় অনার্স রমার পেশা লেখালেখি আর ছেলে দীপঙ্করও লিখতেন–প্রকাশক হতে চেয়েছিলেন। সেই লেখক ছেলেও মাকে ছেড়ে চলে যান, বেশ ক’বছর আগে। কোনও এক বিজয় দিবসে। একপাটি নতুন জুতা পা থেকে খুলে গিয়েছিল দীপঙ্করের। বাসে ঝোলা দীপঙ্কর সেটা খুঁজতে নেমে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেই থেকে মা রমা খালি পায়ে, ফেরি করেন তার নিজের লেখা বই। আর তার বইয়ের কাজ থেকে শুরু করে, মাছের কাঁটা বেছে গত ১২/১৪ বছর ধরে ভাত খাইয়ে দেন ভাসতে ভাসতে আসা এক সন্তান, আলাউদ্দিন খোকন। বরিশালের এই ছেলে এখন রমার ছেলে।
তূর্য্য, কারু তিতাস বা আলাউদ্দিন খোকনের মধ্যে যে মর্যাদাবোধের গর্ব, তা মায়েদের কাছে থেকে থেকেই পাওয়া। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বা রমা চৌধুরীর অবদান বাংলাদেশের ‘বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠায়। তাদের চিকিৎসার তদারকি, তারপর কী, কে কী করবে, এসব মুখে বলা– আলোর অবমাননা। ল্যাবএইড হাসপাতালের ৫০২ কেবিনে এমনি আড্ডায় মা ফেরদৌসী একটু যোগ করলেন, ‘তোমরা সবাই ভালোবাসো বলেই, মর্যাদায় রেখেছ বলেই আমরা আনন্দে বাঁচি। আসলে যার যার বাঁচার প্ল্যান তারই করে রাখতে হয়।’ ঠিক বলেছ মামনি, রমা চৌধুরী দান অনুগ্রহ নেন না। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাকে বুকে নিয়ে জানতে চেয়েছেন ‘কী চান’? রমা নিজের উপার্জনে চলার কথা বলেছেন। খবর নিয়ে জেনেছি, গতকালই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন রমা চৌধুরীর বই কিনেছেন, ৯০ হাজার টাকার। আরও অনেক বড় বড় গ্রুপ অগ্রিম দিয়ে চাইছেন। তাতে চিকিৎসা হচ্ছে শুনে খুশি রমা, খুশি বাংলাদেশও। এই বাংলাদেশেই বাঁচার আকুতি তার। প্রিয় এই ভাস্কর, মুক্তিযোদ্ধা মায়ের কাছে এবার অনুমতি চাওয়া ‘মামনি তোমার ভাস্কর্যগুলোর একটা প্রদর্শনী বা বিক্রয়কেন্দ্র থাকলে কেমন হয়? আমরা আরও আরও বেশি কাটুম-কুটুম পাই। তুমি প্রতিদিন ব্যস্ততার মর্যাদায় বাঁচো!’
লেখক: প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন নিউজ