আল্লামা শফির বয়ানের জবাবে তসলিমা যা বললেন
এই তো দু’চার দিন হলো হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী এক সম্মেলনে ১৫ হাজার উপস্থিত লোককে শপথ করালেন তাঁরা যেন তাঁদের কন্যা-সন্তানকে স্কুল-কলেজে না পাঠান, লেখাপড়া না করান। যদি করাতেই হয়, তবে যেন চার বা পাঁচ ক্লাসের বেশি না করান। এই চার বা পাঁচ ক্লাস পড়ানোর কারণ সম্পূর্ণই হলো স্বামীকে যেন প্রয়োজনে চিঠি লিখতে পারে আর স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব রাখতে পারে। ১৫ হাজার পুরুষ শুনলেন, বুঝলেন, শপথ করলেন। নারী শিক্ষাবিরোধী এবং নারী স্বাধীনতাবিরোধী বক্তব্য সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন থেকে অহরহই প্রচার করা হয়, এ নতুন কোনও ঘটনা নয়। যেহেতু আল্লামা শফীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক, সে কারণেই চমকে উঠতে হয়, একজন শিক্ষিত নারীর অনুকম্পা পেয়েও নারী শিক্ষাবিরোধী প্ররোচনায় কী করে আজও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন! আবার দুঃখও হয়, আমাদের দেশের বিচক্ষণ রাজনীতিকরা কী করে নারীবিদ্বেষী মোল্লাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেন। বিচক্ষণ বিদুষী রাজনীতিকের যে গুণটি থাকে, সেটি হলো দূরদর্শিতা। দূরদর্শী কেউ কি নারীবিরোধী গোষ্ঠীকে নারীবিরোধ চালিয়ে যেতে দেবেন নাকি এসব বন্ধ করবেন? আমাদের অঞ্চলের রাজনীতিকদের দূরদর্শিতা অবশ্য গ-মূর্খদের মধ্যে কী করে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে ক্ষমতার শিখরে এক লাফে উঠে যাওয়া যায়, সেদিকেই ভালো কাজ করে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক রাজনীতিকদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত বললেই চলে।
হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী এ যাবৎ নারীবিরোধী কথাবার্তা কম বলেননি। নিশ্চয়ই তিনি ঘরের ভিতর দিনরাতই লোকদের ওয়াদা করান, যেন তারা তাদের কন্যাকে স্কুল-কলেজে না পাঠায়। কিন্তু স্পর্ধা এতটাই যে তিনি খোলা আকাশের নিচে, সারা দেশকে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও শুনিয়ে বলে দিলেন দেশের সংবিধানবিরোধী কথা। এই স্পর্ধা তিনি কোথায় পেয়েছেন, আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি। আমরা হতভাগারা, জীবনভর নারীর শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতার পক্ষে সংগ্রাম করে যতটা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাই, এক ধাক্কায় সেই সমাজকে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ পিছিয়ে দেয় এমন সব নেতিবাচক ভাষণ। এই ভাষণগুলোই শুনছে তারা, যারা ভাষণদাতাদের সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার আশীর্বাদপ্রাপ্ত মহামানব বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং তারা, কোনও সন্দেহ নেই যে, ভাষণদাতার প্রতিটি আদেশ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
দেশের ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসার ১৪ লাখ শিক্ষার্থীকে কোরআন-হাদিস পড়ানো হয়। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা কিন্তু শিখে যায় অবিজ্ঞান, অলৌকিকতা, পশ্চাৎপদতা, নারীবিদ্বেষ, কুসংস্কার। আল্লামা শফী একজন প্রখ্যাত সেলেব্রিটি, প্রায়ই তিনি নারীবিরোধী বক্তব্য, বিবৃতি দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে নারী হয়েও সুসম্পর্ক রাখছেন আল্লামা শফীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর সান্নিধ্যে আমি ভেবেছিলাম আল্লামা শফীর নারীবিদ্বেষী মানসিকতার পরিবর্তন হবে, ভেবেছিলাম তাঁর বোধোদয় হবে, এইবার বুঝি তিনি নারীশিক্ষা এবং নারীর সমানাধিকারের পক্ষে তাঁর লাখ লাখ অনুরাগীকে অনুপ্রাণিত করবেন। যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা-সমর্থন অকাতরে বর্ষণ করেও আল্লামা শফীর নারীবিদ্বেষী মানসিকতার এতটুকুও পরিবর্তন না করতে পারেন, তবে তাঁদের মধ্যে কীসের এত লেনদেন, বড় জানতে ইচ্ছে করে। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পাওয়ার আগে আল্লামা শফী যা ছিলেন, সমর্থন পাওয়ার পরেও তিনি ঠিক তাই। তবে কি প্রধানমন্ত্রী আল্লামা শফীকে পরিবর্তন করার বদলে আল্লামা শফীই প্রধানমন্ত্রীকে পরিবর্তন করছেন? তিনিও কি ধীরে ধীরে নারীর শিক্ষা-স্বনির্ভরতা-সমানাধিকারের বিপক্ষেই এক সময় বক্তব্য রাখবেন? আমরা চারদিককার অন্যায় অবিচার, বঞ্চনা বৈষম্য দেখতে দেখতে, বিস্মিত হতে হতে, এমন পাথর হয়ে গেছি যে কোনও কিছুতেই আর বিস্মিত হই না। শেখ হাসিনার মতো শিক্ষিত রাজনীতিক যখন বলেন তিনি মদিনা সনদে দেশ চালাবেন, তখনও অবাক হই না। দেশের নাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বদলে যদি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র করা হয় অদূর ভবিষ্যতে, তখন কি অবাক হব? মনে হয় না তখনও অবাক হব।
আল্লামা শফী এই প্রথম নয়, কয়েক বছর আগেও তিনি জনসভায় ঠিক এভাবে বলেছেন, ‘আপনারা মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতেছেন। কেন করাইতেছেন? তাদের ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াইবেন যাতে বিবাহশাদি দিলে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। আপনার মেয়েকে স্কুল-কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াইতেছেন, লাখ লাখ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পর আপনার মেয়ে, নিজে নিজে একটা স্বামী জোগাড় কইরা লাভ ম্যারেজ, কোর্ট ম্যারেজ কইরা চইলা যাবে। আপনার কথা স্মরণ করবে না। মহিলাদের ক্লাসে সামনের দিকে বসানো হয়, পুরুষরা কী লেখাপড়া করবে?’
তিনি নারীর স্বনির্ভরতা চান না। তাই নারীর স্বনির্ভরতার বিপক্ষে তিনি নিরবধি বলে যাচ্ছেন। যে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে চালাচ্ছে মূলত গরিব মেয়েরা, সেই মেয়েদের বিরুদ্ধে আল্লামা শফী বলেছেন, ‘আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেকে করতেছেন। আপনি নিজে করতেছেন, আপনার বউ করতেছে, মেয়েরা করতেছে। কিন্তু তারপরও তো পারতেছেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে শুধু স্বামী রোজগার করত আর সবাই মিইলা খাইত। এখন বরকত নেই। সবাই মিল্লা এত টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেছেন না। গার্মেন্টে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭-৮টায় যায়, রাত ১০-১২টায়ও আসে না। কোনও পুরুষের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, তুমি তো জান না। কতজনের সঙ্গে আপনার মেয়ে চলছে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেছে, বরকত থাকবে কেমনে। মেয়েদের কাজ ঘরের ভিতর। নারীদের ঘরে থাকতে বলেছে ইসলাম। তোমরা জাহিলিয়াতের সময়ের মতো বেপর্দায় ঘর থেকে বাইর হইও না, উলঙ্গ অবস্থায় মাঠে-ঘাটে-হাটে আপনারা মহিলারা মার্কেট করতে যাবেন না। স্বামী আছে সন্তান আছে তাদের যাইতে বলবেন। আপনি কেন যাবেন? আপনি স্বামীর ঘরের মধ্যে থাইকা উনার আসবাবপত্র এগুলার হেফাজত করবেন। ছেলে-সন্তান লালন-পালন করবেন। এগুলা আপনার কাজ। আপনি বাইরে কেন যাবেন?’
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটছে যে দেশে, সে দেশে বসে আল্লামা শফী জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন করেন? বার্থ কন্ট্রোল কেন করেন? বার্থ কন্ট্রোল হলো পুরুষদের মরদা থাইকা খাসি কইরা ফেলা। মহিলাদের জন্মদানী সেলাই কইরা দেওয়া। এরই নাম বার্থ কন্ট্রোল। বার্থ কন্ট্রোল করলেও ডেথ তো কন্ট্রোল করতে পারবা না। রিজিকের মালিক হচ্ছে আল্লাহ। খাওয়াইব তো উনি। তুমি কেন বার্থ কন্ট্রোল করবা? বড় গুনাহের কাজ এইটা। পারলে চাইরটা পর্যন্ত বিবাহ করবা। খাওয়াইব তো আল্লাহ। বার্থ কন্ট্রোল করবা না। এইটা বড় গুনাহের কাজ।’
এও দেশের স্বার্থবিরোধী নীতিবিরোধী বক্তব্য। বাংলাদেশ সরকার আজ চার যুগ ধরে নারী পুরুষকে পরিবার পরিকল্পনা করতে উৎসাহ দিচ্ছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অকালমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি থেকে ধীরে ধীরে মানুষ যখন বেঁচে বেরোচ্ছে, তখনই দেখছি জনতাকে পেছনে অন্ধকারের দিকে, অসুস্থতার দিকে, অনিয়ন্ত্রণের দিকে ধর্মের নামে ঠেলে দিচ্ছে আল্লামা শফী এবং তাঁর মতো অসংখ্য মৌলবাদী। দেশের ভালো চাইলে এই অপশক্তিকে এখন শক্ত হাতে ঠেকানো ছাড়া আর কোনও উপায় কি সরকারের আছে? এই অপশক্তি সরকারের সুনজর পেতে পেতে এমনই ভয়ঙ্কর দৈত্যে পরিণত হয়েছে যে, এদের ঠেকানো মোটেও সহজ কাজ নয়। অন্তত সংবিধানবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, নারীর অধিকারবিরোধী কর্মকা- থেকে তাদের বিরত করার ব্যবস্থা তো যে করেই হোক করতে হবেই।
মেয়েদের সম্পর্কে আল্লামা শফীর যে বক্তব্য মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তা হলো, ‘মেয়েরা তেঁতুলের মতো’। সেদিন ঠিক কী বলেছিলেন শফী? বলেছিলেন, ‘মেয়েরা হচ্ছে তেঁতুলের মতো। ছোট্ট একটা ছেলে তেঁতুল খাইতেছে, তা দেখলে আপনার মুখ দিয়া লালা ঝরবে। তেঁতুল গাছের নিচ দিয়া আপনি হাঁইটা যান তাইলেও আপনার লালা ঝরবে। দোকানে তেঁতুল বিক্রি হইতে দেখলেও আপনার লালা ঝরবে। ঠিক তেমনি মহিলাদের দেখলে দিলের মাঝে লালা ঝরে। বিবাহ করতে মন চায়। লাভ ম্যারেজ কোর্ট ম্যারেজ করতে মন চায়। দিনরাত মেয়েদের সঙ্গে পড়ালেখা করতেছেন, আপনারা দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। রাস্তাঘাটে মেয়েদের সঙ্গে চলাফেরা করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। যতই বুজুর্গ হন আপনার মনের মাঝে কু খেয়াল আইসা যাবে। এইটা মনের জেনা, দিলের জেনা। এইটা এক সময় আসল জেনায় পরিণত হবে।’
এর অর্থ মেয়েদের ঘরবন্দি করতে হবে, বোরখাবন্দি করতে হবে। মেয়েদের অবয়বহীন করতে হবে, অস্তিত্বহীন করতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পুরুষ যেমন রক্তমাংসের মানুষ, মেয়েরাও ঠিক তেমন রক্তমাংসের মানুষ। সভ্য সমাজ গড়তে হলে নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া গতি নেই। অথচ অগুনতি অসভ্য লোকেরা এই সমানাধিকারের বিরুদ্ধে তো প্রচার চালাচ্ছেই, শুধু তা-ই নয়, মেয়েদের যেন নিতান্তই ঘৃণ্য বস্তু, যৌন বস্তু, নিতান্তই ক্রীতদাসী ছাড়া আর বেশি কিছু না ভাবে কেউ, এ ব্যাপারেও নিরবধি মগজধোলাই চলছে। নতুন প্রজন্ম অতঃপর শফীর পদাঙ্কই তো অনুসরণ করবে। জনসংখ্যার অর্ধেকের অধিকার লংঘন করবে, ঘরে বসিয়ে নির্যাতন করবেন এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকেই তাহলে কি মানুষ যাচ্ছে? গোটা একটি দেশকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীবিরোধী পুরুষেরা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেবে, আর আমাদের তা চুপচাপ মেনে নিতে হবে? সরকার যদি এখনও সচেতন না হয়, তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দেশটি আলাদা হয়েছেন এ নিয়ে গর্ব করার আর সুযোগ থাকবে না, বরং পাকিস্তানকে বলতে শুনবো, পাকিস্তান এই দেশকে আলাদা করে দিয়ে বড় বাঁচা বেঁচেছে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
সূত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিন