২৩ বছরের তরুণী আফরোজা আলী। অভিজাত ঘরের সন্তান। চেহারায়-পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ। পড়ালেখা করেন নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চলাফেরা করেন শহরের পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলেদের সঙ্গে। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াবায় হাতেখড়ি হয়। প্রথমে শখের বশে একটান-দুইটান। ধীরে ধীরে নেশায় পরিণত হয়। লেখাপড়া থেকে দূরে সরে আসেন। দিন-রাত পার্টি আড্ডা মাস্তিতে মজে থাকেন। বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন পরিবারের মায়ার বন্ধন থেকে। ব্যবসায়ী বাবা একমাত্র সন্তানের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। প্রায়ই বাসায় বেপরোয়া ছেলেদের আনাগোনা  থাকে।

মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে জমায় ইয়াবার আসর। ইয়াবার টাকা যোগান দেয়ার জন্য বাবাকে প্রতিনিয়ত চাপ দিতে থাকে। ব্যবসায়ী বাবা এক সময় বুঝতে পারেন। মেয়ে নেশার জগতে বুঁদ হয়ে থাকে। বন্ধ করে দেন টাকা পয়সা দেয়া ও বাইরে যাওয়া। তবুও থেমে থাকেনি তার নেশার জগতে বিচরণ। বন্ধুরাই এবার ইয়াবার টাকা যোগাচ্ছে। নেশার করাল গ্রাসে আফরোজা একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবা-মা বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে যান কলকাতার একটি হাসপাতালে। বর্তমানে সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সেখানেই চিকিৎসাধীন। আফরোজার মতো ইয়াবার মরণ ছোবলের শিকার আরো অসংখ্য তরুণ-তরুণী।

পরিবারের সঙ্গে ধানমন্ডিতে থাকে ২৭ বছর বয়সী যুবক সুদ্বীপ। বাবা একটি বায়িং হাইজের বড় কর্মকর্তা হওয়াতে প্রায়ই বিদেশে আসা-যাওয়া। বাসায় মা ও ছোট এক বোন ছাড়া আর কেউ থাকে না। সুদ্বীপ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর কিছুদিন ধরে কর্মহীন সময় পার করছিলেন। পাড়ার সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডায় যায় দিন রাতের অধিকাংশ সময়। কখনো বাসায় আবার কখনো বন্ধুদের সঙ্গে রাত কাটে। সুঠাম দেহের অধীকারী সুদ্বীপ ধীরে ধীরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পরে আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে তাকে ঢাকার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে।

শুধু আফরোজা আলী আর  সুদ্বীপ নন দেশে এখন ইয়াবাসেবী ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি কিছু সংগঠনের হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের সর্বত্রই এখন ইয়াবার ছড়াছড়ি। টাকা হলে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। রাজধানীতে এমন কোনো অলিগলি নাই যেখানে ইয়াবা বিক্রেতা আর ইয়াবাসেবী পাওয়া যাবে না। ইয়াবার করাল গ্রাসে ইয়াবাসেবীদের দিনের পর দিন পরিবারের মায়ার বন্ধন ও সমাজ থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময় ইয়াবা সেবনের পর তারা মারাত্মক রোগ ব্যাধিতে ভুগছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশনায় অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরীরর একটি লেখা থেকে জানা যায়, দেশে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা মাদকাসক্তদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

নারী আসক্তদের মধ্যে ৯০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বাকিদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ বছর। তারা ছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী রয়েছেন। ঢাকা শহরের নামিদামি বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ হাজারের বেশি ছাত্রী মাদকাসক্ত। তবে মোট মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক এবং তাদের ৪৩ শতাংশই বেকার। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তারা এখন ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবা দেশের যুব সমাজকে গিলে খাচ্ছে। প্রতিদিন যেরকম ইয়াবা ধরা পড়ছে। ঠিক তেমনি  হাজার হাজার পিস ইয়াবা দেশে সেবন হচ্ছে।

একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকার ইয়াবা সেবন করে। যা মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার ইয়াবা কেনাবেচা করে। তবে ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ৮৫ ভাগ ইয়াবাতে ভেজাল রয়েছে। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ২০১৬ সালে ঢাকা আহছানিয়া মিশনে চিকিৎসা নিতে আসা ২৬৩ জন পুরুষ রোগীর মধ্যে একটি জরিপ চালানো হয়। তাদের ৪১ শতাংশই ইয়াবাসেবী। ১০৬ জন নারী মাদকসেবীর মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, তাদের ৪৩ শতাংশ ইয়াবাসেবী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়।

পার্শ্ববর্তী দেশ হতে চোরাচালানের মাধ্যমে এদেশে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করে। ভৌগোলিকভাবে গোল্ডেন ট্রায়াংগেল  (মিয়ানমার, লাউস, থাইল্যান্ড) ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান) এবং গোল্ডেন ওয়েজ (নেপাল, ভুটান তিব্বত) এই তিন মাদক বলয়ের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় মাদক ট্রাফিকিং রুট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের ৩২টি জেলা ও ১৩২টি উপজেলার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। তন্মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৪১৫৬ বর্গকিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল ও নদীপথে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার নাফ নদের  জামীরমুরা পয়েন্ট থেকে শাহপরী দ্বীপ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ইয়াবা পাচারের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত ক্রসিং পয়েন্ট। পাচারকৃত ইয়াবার সিংহভাগই নৌপথে নাফ নদ ও তৎসংলগ্ন অববাহিকা ও সমুদ্র উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলার মহেশখালী ও কুতুবদিয়া চ্যানেল, টেকনাফ ও উখিয়া উপকূল, চট্টগ্রাম উপকূল, পটুয়াখালী উপকূলীয় অঞ্চল এমনকি গভীর সমুদ্র দিয়ে জেলে নৌকা দিয়ে দেশে প্রবেশ করে।

টেকনাফ-উখিয়া হয়ে পাচারকৃত ইয়াবা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢোকার পর কক্সবাজার টেকনাফ ভায়া উখিয়া সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ এলজিইডি সড়ক দিয়ে ইয়াবা পাচার হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যেসব রুট দিয়ে দেশে ইয়াবা ঢুকছে সেসব রুট যদি বন্ধ করা না যায় তবে অচিরেই দেশে ইয়াবাসেবীদের সংখ্যা আরো বাড়বে। ইয়াবা সেবনকারীদের একসময় চিন্তা শক্তি হ্রাস পায়, ক্ষুধা কমে যায়, শ্বসন ও হাইপোথারিয়া সেই সঙ্গে আনন্দ চঞ্চল অবস্থার স্থিরতা, অনিদ্রা, বিরক্ত এবং আগ্রাসী মনোভাব, বমিবমি ভাব, খারাপ স্মৃতি চারণায় শুকনো মুখ, মস্তিষ্কের মধ্যে ছোট রক্তনালী সমুহ ড্যামেজ হওয়া, অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন, শিরার টান, রক্তচাপ এবং শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তন হতে দেখা যায়।

এ ছাড়া পুরাতন ইয়াবাসেবীদের ক্ষেত্রে আরো বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি এক সময় মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে পড়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, সারা দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই তালিকানুযায়ী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু ইয়াবা না সব ধরনের মাদক নির্মূলে অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn