একাত্তরের কলম যুদ্ধাঃ মুহাম্মদ আব্দুল হাই-গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী
গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী–
এক.বালাট,ভারত, উনিশশ একাত্তর আগস্ট, তৃতীয় সপ্তাহ :-
এক বিকেলে অনিল তালুকদার (শহিদ), ছানু মিয়া, শফিক, আলী হায়দার, আব্দুর রহিম, মানিক বরণ দাস. নুর ইসলাম এবং আমি বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসছিলাম। আই বি এবং তৃতীয় শ্রেণীর পিডবি¬উডি কোয়ার্টারসমূহের ঢালে লালপানির পথে তিনি তাঁর প্রিয় সাইকেলটি পাশে নিয়ে দাঁিড়য়ে ছিলেন। আমি সুনামগঞ্জের এক সময়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতা-প্রকাশনা অঙ্গনের প্রাণপুরুষ মরহুম আব্দুল হাই-এর কথা বলছি।
১৪ আগস্টকে সামনে রেখে সুনামগঞ্জের অদুরে মল্লিকপুরের কাছে একটি ছোট্ট তাৎক্ষণিক অপারেশন সেরে আমরা পূর্ব নির্দেশ না থাকা সত্বেও তথাকার একজন বিশিষ্ট পাক সহযোগিকে কাবু করার অভিপ্রায়ে জয়কলস গিয়েছিলাম। অন্য অনেক কমান্ডারের মত আমরাও তাকে কাবু করতে ব্যর্থ হই, অধিকন্তু বেকায়দায় পড়ে আমন ক্ষেতে একটা রাত লুকিয়ে কাটাতে হয়; ফলশ্র“তিতে হেডকোয়ার্টারে ফিরতে আমাদের কয়েকদিন বিলম্ব হয়েছিল। রটে যায়, আমরা ধরা পড়ে নিহত হয়েছি।
তিনি আমাদের দেখেই চিৎকার করে থামালেন এবং ব্যতিক্রমি উচ্ছ¡সিত কন্ঠে বল্লেন, যাক, বেঁচে আছ তাহলে। তিনি দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই সাইকেলের সিটে কাগজ রেখে আমাদের অপারেশনের বিবরণ নিলেন এবং বলে¬ন, কালই আকাশবাণীতে পাঠাব।এভাবেই তিনি যুদ্বের খবরাখবর জানতে বালাটের টিলা থেকে নেমে প্রায়ই বাংলাবাজার-লালপানির পথ বেয়ে বালাদেশের অনেক ভেতর পর্যন্ত চলে যেতেন। সাব-সেক্টর গোয়েন্দা শাখার কমান্ডার হিসেবেও আমি তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য দ্বারা উপকৃত হয়েছি। উলে¬খ করা যেতে পারে যে গেরিলা গোয়েন্দা কার্যক্রমে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি গ্র“প যুদ্ধের মধ্য পর্যায়ে বালাট এসেছিল। গ্র“পটিকে আমার নেতৃত্বাধীন বালাট-১ কোম্পানীতে ন্যস্ত করা হয়। কিশোরগঞ্জের এডভোকেট আব্দুল আউয়াল ছিলেন এর ডেপুটি কমান্ডার।
জনাব আব্দুল হাইয়ের একটা আলোকোজ্বল সংগ্রামী অতীত আছে; ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জনগনের সকল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আর রাজনৈতিক সংগঠনে বরাবরই তাঁর একটা বিশিষ্ট ভূমিকা থাকত। তিনি ষাটের দশকের একটা সময়ে সার্বিক রাজনৈতিক অঙ্গেেনর চাইতে শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিকে বেশী ঝুকে পড়েন । তিনি এক আশ্চর্য এবং রহস্যময় চরিত্রের মানুষ ছিলেন। সে সময়টায় তিনি মূলত শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়েই কথাবার্তা বলতেন। এমনকি প্রত্যক্ষ জীবন থেকে নেয়া অনেক সরস হিউমারও তাঁর কথাবার্তায় থাকত। তিনি তখন রাজনীতি নিয়ে খুব কম এবং অর্থ-বিত্ত নিয়ে একেবারেই শূন্য পরিমাণ কথাবার্তা বলতেন।
তাঁর নিজের ভাগ্যোন্নয়নে কাজে না লাগলেও ঐ সময়ে তাঁর কুশলী সাংগঠনিক ভূমিকা সুনামগজ্ঞের শিক্ষা-সংস্কৃতির তথা সাহিত্য-সাংবাদিকতা-প্রকাশনা-সঙ্গীত ইত্যাদির বিকাশের ক্ষেত্রে দারুন ইতিবাচক অবদান রেখেছিল। আর্টস কাউন্সিল, হাছন মেলা, কৃষি-শিক্ষা-শিল্প ও স্বাস্থ্য প্রদর্শনী কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিকে ঘিরে ষাটের দশকে যে অভূতপূর্ব একটা সাংস্কৃতিক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল সুনামগঞ্জে, তার কেন্দ্রবিন্দু থাকতেন তিনিই। আসলে তিনি সংগোপনে তাঁর পদচারনার ক্ষেত্র হিসেবে অনির্দিষ্ট সামষ্টিক থেকে সুনির্দিষ্ট ব্যষ্টিকে অর্থাৎ সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধপূর্ব উত্তাল সময়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যথাযথ ভূমিকা রাখতে একটুও বিলম্ব করেননি। ফলে একাত্তরের ১০ মে সুনামগঞ্জ বিপুল সংখ্যক পাক সেনা কর্তৃক পূণরাক্রান্ত হলে অপরাপর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁকেও সুনামগঞ্জ ছাড়তে হয়।
মুুক্তিযুদ্ধকালে বালাট-মৈলামের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত মূল কমিটির মুখ্য নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন তিনি। তবে তাঁর স্বভাবসুলভ পদচারনার ক্ষেত্রটাকে তিনি গভীর মমতায় আকড়ে ধরে রেখেছিলেন তখনও। বালাটের মত একটি পশ্চাদপদ জায়গা থেকে তিনি নিজ উদ্যোগে যুদ্ধের এবং যুদ্ধ-সম্পৃক্ত বিষয়ের সংবাদ আকাশবাণী সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করতেন। মুক্তিযুদ্বের সংগঠক হিসেবে, এমনকি সহায়ক ভূমিকা রাখা সে কমিটির অনেকেই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হয়েছেন এবং সনদ লাভ করেছেন। মরহুম আবদুল হাই কি পেলেন জানিনা। যুদ্ধের সময়ে তিনি কি করেছেন এ নিয়ে একদিনও তাঁকে কথা বলতে শুনিনি। আমি শুধু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
দুই. যিনি পেছন থেকে অন্যকে তুলে ধরতেন-
তখন তিনি তদানীন্তন সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক ছিলেন, সেখানে আমি মাঝে মাঝে পত্রিকা পড়তে যেতাম। কিছু কিছু বইও আলমিরা থেকে বের করে নিয়ে মাঝে মাঝে দেখতাম। এক সন্ধ্যায় তেমনি বইপত্র নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে বসেছিলাম, জনাব হাই আমার টেবিলের সামনে এসে বললেন, এখানে একটা আলোচনা সভা হতে যাচ্ছে; বিষয়- ধর্ম বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষতা। তোমাকে ধর্ম-নিরপেক্ষতার উপর বলতে হবে। বিষয়ের অপর অংশটির উপর বলবেন স্বনামধন্য মহকুমা প্রশাসক জনাব এ জেড এম শামসুল আলম। তাঁর অনুরোধটা শুনে মাথায় বজ্রাঘাতের মত অনুভব করলাম। কারণ বিষয়টির উপর আমি কিছুই জানতামনা। তবু অজ্ঞতা ধরা পড়ার ভয়ে মৃদু হেসে সম্মতি জানিয়ে তৎক্ষণাৎ লাইব্রেরি ত্যাগ করলাম।আমার চাইতে অগ্রসর বন্ধুদের সাথে আলাপ করে দেখলাম আমি ঘোর বিপদেই পড়ে গেছি। সম্ভবত: আমার বাচালতায় মুগ্ধ হয়ে স্যার আমাকে এ বিপদে ফেলেছেন। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, কোন একটা জরুরী কাজের অছিলায় স্যারকে বলে সুনামগঞ্জের বাইরে চলে যাব।
পরিকল্পনা মতে এক সময় তাঁর মুর্শেদী প্রেসে গেলাম। কিন্তু আমি কিছু বলার আগে তিনিই শুরু করলেন। প্রথমে ফাররুখ আহমদের একটি অনবদ্য কবিতা পড়ে শোনালেন এবং এর অভূতপূর্ব শব্দশৈলীর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলেন।কবিতাটি শুনে আমি শুরু করলাম, স্যার আমি পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার বিষয়ে বলতে এসেছি।আর কিছু বলতেই পারলামনা, তিনি তাঁর সদ্য পড়ে শেষ করা মোতাহার হোসেন চৌধুরী কৃত ক্লাইভ বেল-এর সিভিলাইজেশনের বাংলা অনুবাদ ‘সভ্যতা’ বইটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার পেপার তৈরী করতে এ বইটি কাজে লাগবে।বইটি নিয়ে আমি প্রেস থেকে চলে আসি। যা বলতে গিয়েছিলাম তা আর বলার সুযোগ পাইনি। হ্যা, বইটি খুবই কাজে লেগেছিল…প্রধানত সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়েই একটা কিছু খাড়া করতে পেরেছিলাম সেদিন।
দৈনিক মর্নিং নিউজে আলোচনা সভাটির বিবরণ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়; খুব সম্ভব বিশিষ্ট সাংবাদিক (পরে প্রথিতযশা সিভিল সার্ভেন্ট) জনাব সাকিরউদ্দিন আহমেদ সংবাদটি পাঠিয়েছিলেন। জনাব হাই পত্রিকাটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, দেখ। কিন্তু আমি বেশী করে দেখলাম তাঁকেÑ যিনি অন্যকে বিকশিত হতে সহায়ক ভূমিকা রাখতেন, তাদের কাজ নিজে করে দিতেননা, তাদের অজ্ঞতাকে তিনি আলোচনায় আনতেননা; সমালোচনায়তো নয়ই।
তিন. সূর্যের দেশ ও আব্দুল হাই-
স¤প্রতি একাত্তরকে নিয়ে একটা নিবন্ধ লিখতে গিয়ে দেখি- কি করে মুক্তিযোদ্ধা হলাম, ভারতে গেলাম কিভাবে, সে স্মৃতি বেশ আবছা হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত “সূর্যের দেশ” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় “জলছবি” শিরোনামে পঁচিশ-ত্রিশটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায়। পত্রিকাটির প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন মরহুম আব্দুল হাই। আমি কার্যকরী সম্পাদক হই। মফস্বলের পত্রিকা হলেও এটি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছিলো। ঐসব ফিচারে আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণণা ছিলো; ফিচারগুলো একীকৃত হলে একরকম বইয়ের মতো হয়ে যেতো। একীকৃত বাধাঁই করা ফিচারগুলো জনাব আব্দুল হাই এর কাছে রেখে এসেছিলাম।
সূর্যের দেশ ছেড়ে ১৯৭৩ সালে চাকুরী নিয়ে ঢাকা চলে যাই। কিছুকাল পর একবার স্টেডিয়াম মার্কেটে বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে থাকা দু’ তিনটি ফিচার তাঁকে দেখাই। তখন সবেমাত্র তাঁর “শ্যামল ছায়া” প্রকাশিত হয়েছে। ফিচারগুলো দেখে তিনি সবগুলো ফিচার বই আকারে প্রকাশনার জন্য ঢাকা নিয়ে আসতে বলেন। আমি ছুটি নিয়ে সুনামগঞ্জ গিয়ে আব্দুল হাই সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। জনাব হাই তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জানালেন, বইটা তিনিই প্রকাশ করবেন। তিনি কখনোই কোন নেতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করতেননা; ”না” বলতেন খুবই কম। আমার কাছে লেখাগুলোর কোনো কপি ছিলনা। স¤প্রতি কিছু কিছু ফিচারের কপি বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা গেলেও এর কোনো ধারাবাহিকতা নেই। এরপর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল দীর্ঘ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পর, তাঁর হাতিরপুলের ফ্ল্যাটে। আমাকে তিনি অনেক সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু পূণঃ লেখার তাগিদ দেয়ায় অধ্যাবধি তাঁর সাথে আর দেখা করিনি আমি।
শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই সাহেব উদাস হয়ে যান; “হাছন উদাস” নাম ধারণ করেন। হাই সাহেব এমনিতেই কথা কম বলতেন। উদাস হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাথে কথা বলা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমার কাছে তিনি এমনিতেই একজন মহাপ্রান বড় মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন; কিন্তু তাঁর সে সময়কার উদাস ধ্যানীর মগ্নতার অর্থ বের করার সাধ্যি আমার ছিলনা। তাঁর সে রকম মানসিক পরিস্থিতিতেই তিনি একবার ঢাকা গিয়েছিলেন; উঠেছিলেন সদরঘাট শংকর বোর্ডিং-এ। সদা পরিচ্ছন্ন মানুষটির তখন এলোমেলো চেহারা আর রূক্ষ বেশ; পুরানো জানালার ফোকর গলিয়ে উত্তপ্ত রৌদ্র কিরণ সরাসরি তাঁর মাথায় পড়ছে। আমি তাঁকে দু’একদিন আমার আবাসস্থলে নিতে পেরেছিলাম, কিন্তু হ্যাঁ-না ধরণের কিছু কথা ছাড়া কিছু বলেননি।
সুনামগঞ্জের সাথে প্রায় চলি¬¬শ বছর যাবত আমার কোনই যোগযোগ নেই। ঐ লেখাগুলি তখন না পাওয়ায় ভালোই হয়েছে, কারণ সে লেখায় প্রকাশিত আমার অনেক মতামতের সাথে আমি আজ নিজেই ভিন্ন মত পোষণ করি । শুধু দু:খ এই যে তাঁর মতো একজন অসাধারণ মানুষ অকালে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন।আসলে তাঁকে ধারণ করার মতো পারিপার্শ্বিকতা তাঁর সামনে একেবারেই ছিলোনা এবং মনে হয়, এ শূণ্যতা তাঁকে মানসিকভাবে ভয়ানক পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল সে সময়টায়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সে ঘোর দুর্বিপাকেও তিনি আপন ব্যক্তিত্বকে খাটো করেননি , আ্রশ্রয় নেননি কোন অসংলগ্ন প্রগলভতার।
স্বাধীনতার পর মুর্শেদী প্রেস থেকে সদ্য প্রকাশিত ‘সূর্যের দেশ’-কে কেন্দ্র করে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্টতর হয়েছিল। নূতন নূতন পত্রিকা, সাময়িকী, সংকলন কিংবা বুলেটিন বের করা ছিল তাঁর একটা নেশা। পাকিস্তান আমলে তাঁর সম্পাদিত পাক্ষিক ‘সুরমা’ পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় তিনি আমাকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তখন থেকে আমি যতদিন সুনামগঞ্জে ছিলাম, তাঁর সকল উদ্যোগেই তিনি আমাকে সম্পৃক্ত রাখতেন। ‘সুরমা’ পত্রিকাটি মৌলিক গণতন্ত্রের মুখপত্র ছিল। কিন্তু তিনি একে প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটি বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকতেন।
স্বাধীনতাপূর্ব কালে তিনি ’তরঙ্গ’ নামের একটি ভালো অর্ধ-বাৎসরিক বুলেটিন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । এর একটি সংখ্যা পশ্চিমবাজার গুলিস্তান প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল। বেশ বড় আকারের ঐ সংকলনটিতে তিনি আমাকে এবং তাঁর আরেক স্নেহভাজন বিশিষ্ট আইনজীবি ও গ্রন্থকার জনাব আবূ আলী সাজ্জাদ হোসেনকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত রেখেছিলেন। আমাকে ও জনাব আবূ আলী সাজ্জাদ হোসেনকে তিনি অনেক কিছুতেই সম্পৃক্ত রাখতেন। স্বাধীনতার পরও তিনি নিজ প্রেস থেকে ভালো মানের একিিট কবিতা সংকলনও বের করেন। অবশ্য প্রথমে বের করেন অর্ধ সাপ্তাহিক ‘দেেেশর কথা’। এটি সুনামগঞ্জ মহকুমা লেখক সমিতির মুখপত্র হিসেবে স্বাধীনতা সংখ্যা বুলেটিন রূপে বায়াত্বরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রকাশিত হয়। যতদুর মনে পড়ে, দেশের কথার সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজে। আমাকে করেছিলেন সহ-সম্পাদক।
পত্রিকাটির অনিয়মিত প্রকাশনার প্রেক্ষিতে এবং তাঁর আগের অন্যান্য পত্রিকার ক্ষণস্থায়িত্বের নজির টেনে অর্ধ-সাপ্তাহিকের পরিবর্তে “দেশের কথা”-কে সাপ্তাহিকে রূপান্তরের কথা বিবেচনা করতে তাঁকে অনুরোধ জানাই। প্রন্তাবটি তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিবেচনায় নেন এবং সদ্য প্রকাশিত বুলেটিনটি বাদ দিয়ে একটি নূতন সাময়িকী সাপ্তাহিক আকারে বের করার ঘোষণা দেন। নামের ব্যাপারেও তিনি আমার প্রস্তাবটি গ্রহন করেছিলেন; প্রস্তাবিত পত্রিকাটির নাম হয়, সূর্যের দেশ। আমাকে করেন কার্যকরী সমপাদক এবং তিনি নিজে ছিলেন প্রধান সম্পাদক। কিন্তু আমার ন্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই যে শুধু প্িত্রকাটি নয়, কার্যত: আমিও জনাব আব্দুল হাই-এর সৃষ্টি।
চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর মানুষকে বেশী করে সম্পৃক্ত করার দিকেও তাঁর একটা ঝোক ছিল। নূতন পত্রিকাটি কিছুদিন চলার পর আমার সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর বিশদ পরামর্শ হয়। সে ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পর্যায়ে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা, ব্যাংকার ও লেখক ব্রজেন্দ্র দাসের এবং পরে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু রঞ্জিত চৌধুরীর নাম পত্রিকায় যুক্ত হয়। ব্রজেন্দ্র দাসকে সাহিত্য সম্পাদক এবং রঞ্জিত চৌধুরীকে সহকারী সম্পাদক করা হয়েছিল। স্মরণ করতে ভালো লাগে যে সূর্যের দেশ মোটামুটি বেশ কিছুদিন আয়ূ পেয়েছিলো।
সূর্যের দেশ নিয়ে তাঁর অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। আমার সুনামগঞ্জ অবস্থানের শেষ দিন পর্যন্ত তঁÍার স্বপ্নের অনুকুলে আমি রীতি মত প্রেসে বসে সার্বক্ষণিক পত্রিকাটির কাজ করেছি।সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙ্গিনায় মরহুম আব্দুল হাইয়ের কাজকর্মের আমি যতটুকু দেখেছি, উপরের বিবরণ তার কণামাত্রও নয়। আমার দেখার বাইরে তাঁর কাজের পরিধির বিশালত্ব পরিমাপ করার সাধ্য আমার ছিলনা। কিভাবে অনুমান করবো, আত্মগৌরববোধ আর অহমিকার কিংবা আত্মপ্রচারের বাতিক একবিন্দুও যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, তেমন মানুষকে সামনে থেকেও চেনা দায়। তাঁর অন্যান্য গুণের কথা থাক, তিনি যে ছাত্রজীবনে অতিশয় মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনে-সংগ্রামে অগ্রবর্তী ভূমিকার জন্যে রাস্টিকেট পর্যন্ত হয়েছিলেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছিলেন, এমন একটি তথ্যও আমি তাঁর জীবনকালে জানতে পারিনি। আমার মতো কম পানির মাছের ন্যায় মানুষদের বিকশিত হবার নি:শঙ্ক সুযোগ দিতেই কী তিনি তাঁর নিজের ব্যাপারে এমন নির্মোহ থাকতেন?
চার. যে ঋণের শেষ নেই-
জনাব আব্দুল হাই-এর কাছে আমার একটি অপরিশোধ্য ব্যক্তিগত ঋণও আছে। ১৯৭৩ সালে আমাকে একবার সাপে কামড়ায়; তখন রাত প্রায় বারোটা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিতেই সাপের কামড় খেয়ে ঘরে আসি । ত্বরিত গতিতে প্রাথমিক পরীক্ষায় বিষাক্ত সাপের কামড় নিশ্চিত হয়ে ডোরা বেঁধে আমার এক আত্মীয়কে জাগাই। আমরা এক ভবনেই থাকতাম ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে। তখন বন্ধু রঞ্জিত চৌধুরীর জামাইপাড়া বাস স্ট্যান্ডের বাসায় থাকতাম আমরা। গৌরারং-এর এককালের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের রঞ্জিত চৌধুরীর গল্প পরে।
আত্মীয়টিকে একই বাড়ীতে অবস্থানকারী তার এক অধ্যাপক ভাইকে ডেকে তুলতে অনুরোধ করি জরুরী পরামর্শের আশায়। বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে আত্মীয়টি ইতি-উতি করছিলেন আট/দশ ফুট দুরের ভিন্ন ঘরে যেতে। বেপরোয়া হয়ে বৃষ্টিতে আবার ভিজে, পায়ে ডোরা বাঁধা অবস্থায়ই এক দৌড়ে চলে যাই মুর্শেদী প্রেসে আব্দুল হাই সাহেবের কাছে। তিনি তখনো প্রেসে কাজ করছিলেন ; তৎক্ষণাৎ সে ঘোর বর্ষণের মধ্যেই বাইরে গিয়ে ডেকে তুলেন প্রয়াত বন্ধু, সহপাঠী বিজন দত্তকে। বিজন একটা রিক্সা বের করে। সে সখ করে প্রায়ই রিক্সা ও বেবী ট্যাক্সী চালাতো। দু’জনে বৃষ্টিতে ভিজে রিক্সা ঠেলে কুড়ি মিনিটের মধ্যে আমাকে হাজির করে সদর হাসপাতালে।
সৌভাগ্যবশতঃ দু’ ফাইল এন্টিভেনাম পাওয়া যায়; একটির মেয়াদোত্তীর্ণ হতে কয়েকদিন মাত্র বাকি, অপরটি ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ। আমাকে এন্টিভেনাম দেয়া হয়। কাগজপত্রে স্বাক্ষও করেন জনাব আব্দুল হাই। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দু’তিন দিন পরে হাসপাতাল ত্যাগ করি। গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী প্রবীণ সাংবাদিক রাশভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ আব্দুল হাই আর বেপরোয়া বন্ধু বিজন দত্তÑদু’জনকে দেখলাম যেন একবয়সী হিসেবে। সে অবিরাম মুষলধারে ঝরতে থাকা বৃষ্টিতে তাঁদের কারো মাথায় ছাতা ছিলনা। জনাব হাই-এর পরনে ছিল পায়জামা পাঞ্জাবী, যা তাঁর নিত্যদিনের বাইরের পোষাক; বিজনের পরনে ছিল লুঙ্গি আর হাফসার্ট। আজ দুজনের একজনও নেই। আর, থাকলেও সে ঋণ চির অপ্রতিশোধ্য।
লেখক:মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডার ও কমান্ডার, সাবসেক্টর এফ এফ গেরিলা শাখা।ডিউটি সার্জেন্ট, ইকো-ওয়ান গেরিলা ট্রেনিং সেন্টার, মেঘালয়, ভারত। প্রাক্তন পিএমজি/অব: অধ্যক্ষ, পোস্টাল একাডেমি।