এখনও ‘সুমতির মুখে সেফটিপিন’
কুমার সৌরভ
নাটক বা কোন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখন আর দেখা হয়ে উঠে না। গত রবিবার ঈদের ছুটি ছিল। এজন্য সুযোগ হয়ে যায় ‘সুমতির মুখে সেপটিপিন’ নাটকটি দেখার। জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসনরাজা মিলনায়তনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে সাইরেন। এই নাটকটি আমাদের বিদ্রোহী যৌবনকে নাড়া দিয়েছিল ভীষণভাবে। এর নাট্যকার অকাল প্রয়াত গোলাম রাব্বী (গোলাম রব্বানী) ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান এক ব্যক্তি। তিনি নিজেই ছিলেন এক চলমান নাটক। আফসোস হলো এই গুণী ব্যক্তিটি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারেন নি। সুমতির মুখে সেফটিপিন নাটকের মূল চরিত্র মনসাদ এর চরিত্রায়ন করেছিলেন স্বয়ং গোলাম রাব্বী। শহরের লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ছিল মনসাদের বুলি। মনসাদ ছিল চোরাকারবারী, সুদখোর তথা সমাজবিরোধী এক ব্যক্তি নাটকে যাকে রাক্ষস হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই চরিত্রে গোলাম রাব্বীর অভিনয় দক্ষতা আমাদের এতটাই আলোড়িত করেছে যে, ১৯৮৩ সনে প্রথম মঞ্চায়নের পর ইতোমধ্যে ৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই অভিনয় এখনও আমাদের অনেকের মনে তরতাজা। তাই যখন শুনলাম সুমতির মুখে সেফটিপিন মঞ্চায়িত হচ্ছে তখন আর বসে থাকতে পারলাম না। এক ধরনের ঘোর লাগা আগ্রহ নিয়ে নাটকটির মঞ্চায়ন উপভোগ করলাম। নাটক দেখার আগে আমি মনে করেছিলাম, মনসাদের চরিত্রটি বোধ হয় রব্বানী
ভাইয়ের মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু আমার ভুল ভেঙ্গে দিল তরুণ অভিনেতা সামির পল্লব। নতুন প্রজন্মের অভিনেতা হিসেবে মনসাদ চরিত্র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে পল্লব আশির দশকের আমাদের সেই চিরচেনা গোলাম রব্বানীকেই যেন মঞ্চে টেনে এনেছিল। মনসাদের চামচা ফকই চরিত্রে পুলক রাজের সাবলীল অভিনয় দেখে আমার মনে হলো এই প্রতিভাবানদের দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ময়না, ফরিদ, মনসুর, মাস্টার, মতিন ও জায়ফর চরিত্রে যথাক্রমে দ্বীপময় চৌধুরী ডিউক, দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী, আব্দুস সালাম মাহবুব, প্রসেনজিৎ দে, ওয়াসিফ সোলায়মান, অমিত বর্মনসহ সকলের অভিনয় দক্ষতাই দর্শক-শ্রোতা হিসাবে আমাদের প্রভূত আনন্দ জুগিয়েছে। অভিনেতাদের তাই দিলখোলা অভিনন্দন। অশেষ ধন্যবাদ অন্তরালের সেইসব কুশীলবদের, যার অন্যতম একজন জাহাঙ্গীর আলম, তাকে এবং অন্যদের।
একটি জিনিস লক্ষ করলাম, সুমতির মুখে সেফটিপিন নাটকটি দেখতে এত জনসমাগম। সস্তা বিনোদনহীন (এমনকি একটি নারী চরিত্রও নেই এই নাটকে) বক্তব্যাশ্রয়ী একটি নাটক দেখতে হলভর্তি মানুষ দেখে মনে হলো, এতো ভালবাসা এতো আকর্ষণ, এ তো শিল্প-সংস্কৃতির জয়ধ্বনি ঘোষণা করছে। হলের সবগুলো চেয়ার কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এরপরও প্রচুর দর্শক দাঁড়িয়ে হলের ভিতর। আয়োজকরা বুদ্ধি করে চেয়ারের সারি গুলির মাঝখানে হাঁটার যে রাস্তা সেখানটায় বসিয়ে দিলেন তরুণ দর্শকদের । তরুণ দর্শকরা ওখানে বসেই খুশি। একটি নাটকের এই যে দর্শক আকর্ষণ, গণ-সংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত সংস্কৃতিকর্মীদের নিশ্চয়ই এটি আশান্বিত করেছে। নাটকের আগে এক সাবলীল উপস্থাপনায় নির্দেশক ডা. সালেহ আহমদ আলমগীর নাটক রচনার প্রেক্ষাপট ও তৎকালীন শহর সুনামগঞ্জের বর্ণনা দিলেন প্রাঞ্জল কথাশৈলি দিয়ে। তিনি নাটকে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে অনেকগুলো শব্দ ও সংলাপ টেনে এনে কথা বললেন। তিনি নাট্যকার গোলাম রাব্বীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এই প্রজন্মের সাথে। প্রজন্মের সকলে সেই অদেখা নাট্যকারের প্রতি আগ্রহী হলেন, আলোচনাপর্বে দর্শক-নিস্তুব্ধতা দেখে এমনটি মনে হলো। এরপর ড. মোহাম্মদ সাদিক নামক এক বাচিক শিল্পীর বলিষ্ট আলোচনায় বিমোহিত হলাম আমরা সকলে। তিনি আমলা। কিন্তু মননে ভীষণ ভাবে প্রাণময় একজন কবি। তিনি এই নাটকের সৃষ্টিকালীন সময়ের একজন ধাত্রী মা। সাইরেনের সভাপতি ছিলেন তিনি। তাই আলোচনাপর্বে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদের গাম্ভীর্য খসে গিয়ে এদিন বেরিয়ে এল সুনামগঞ্জের সড়কে সুরমার জলে বেড়ে উঠা এক স্বাপ্নিক পুরুষের অবয়ব। তন্ময় হয়ে আমরা শুনছিলাম আশির দশকের সুনামগঞ্জের কথা। সেই সময়ের নাটক, কবিতা, গান ও সাহিত্যচর্চার কথা। এবং গোলাম রাব্বীর কথা তো অবশ্যই। তিনি কথা বলার পর আর কোন কথা অব্যক্ত থাকে না। তাই জেলা প্রশাসক মো: সাবিরুল ইসলাম কথা না বাড়িয়ে নাটক দেখার প্রতিই আগ্রহী হলেন বেশি।
সুমতির মুখে সেফটিপিন কোন নির্দিষ্ট জনপদে (ধরা যেতে পারে এটি সুনামগঞ্জের কোন চেনা এলাকা) এক শোষক অত্যাচারী লোভী মনসাদের লালসার বিস্তার এবং এর বিরুদ্ধে কতিপয় স্বাপ্নিক তরুণের দ্বন্দ্বের একটি স্বল্পদীর্ঘ আখ্যান। এই নাটকে মনসাদ সমাজ আইন প্রতিষ্ঠান সবকিছুর নিয়ন্তা। ‘আইনের গুড়িত্’ থেকে তার দাম্ভিক বেড়ে উঠার কারণে নিষ্পেষিত হয় সাধারণ নাগরিক। এই নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আদর্শবাদী মাস্টারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে ফরিদ ও মনসুররা। কিন্তু তাদের বিদ্রোহ সফল পরিণতি পায় না। বরং ফরিদ প্রাণ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দেয় এই সংগ্রাম কত কঠিন কত সুদীর্ঘকালের। নাটকের শেষে মনসাদ তার বশংবদ ফখই আর ময়নাকে নিয়ে দর্শকদের দিকে মুখ করে বুড়ি আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে মূলত নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার কথাটি জানান দিয়ে যায়। নাট্যকার যে মনসাদ চরিত্র চিত্রণ ও সমকালীন সমাজচিত্র এঁকেছিলেন ৩৪ বছর আগে, সমাজ কি সেখান থেকে একটুখানিও গণমুখী হয়েছে? আমাদের (দর্শক তথা সাধারণ নাগরিক সমাজ) দিকে বুড়ি আঙুল বাড়িয়ে দেয়া মনসাদদের দাপট কি কমেছে এতটুকু? সকলেই বলবেন, না একটুও কমেনি। মনসাদদের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। অনেক অনেক মনসাদ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে ফখই, ময়নার মতো সমাজবিরোধী। ফরিদ, মনসুর, মাস্টারদের অবস্থান ক্রমশই দুর্বল হচ্ছে। নাট্যকার আশির দশকে যে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন তা এই নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে আরও সুতীব্র হয়েছে। দর্শকরা যদি এটুকু উপলব্ধি করতে পারেন তা হলেই কেবল সফল হবে নাটক পরিবেশনার মূল উদ্দেশ্য।
পরিশেষে যৎকিঞ্চিৎ। নাটকের চরিত্রানুসারে মনসাদের নিপীড়নের ফলে দর্শকদের মধ্যে ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হয়েছে সেটি কেন জানি হয়ে উঠে নি। বরং মনে হয়েছে মনসাদের আঞ্চলিক উচ্চারণ রীতি ও অভিনয় পারঙ্গমতার বিষয়টি দর্শকরা উপভোগ করেছেন অন্য এক মাত্রায়। আমি নাটকের তাত্ত্বিক গভীরতা বুঝি না। কেবল একজন সাধারণ শ্রোতা হয়ে আমার এই উপলব্ধি যথাযথ কিনা সেটিও বুঝতে পারছি না।