এটা কী করলা বাবা? মানুষের ভালোবাসায় তোমার রাজকীয় বিদায়
আহনাফ ফাহমিন অন্তর-
এটা কী করলা বাবা? এভাবে কেউ চলে যায় না বলে কিছু? কত স্বপ্ন ছিল তোমার। আমাকে নিয়ে কত চিন্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে গেলাম ল্যাবএইড থেকে, কারণ তোমাকে আইসোলেট করে ডায়ালাইসিস দেওয়া দরকার। সেখানে ভিসি ও ট্রেজারার আন্তরিকভাবে সব ব্যবস্থা করলেন।
৩ নম্বর ডায়ালাইসিস দিতে স্ট্রোক হয়ে গেল। নিয়ে গেলাম ল্যাবএইডে ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। তখনো তুমি কথা বললে, ডাক্তাররাও আশা করছেন যে ঠিক হয়ে যাবে। আমরা রাতেই সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে দিল্লি নেব এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে। বেলা ১১টার মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলাম।
এরপর সুনামগঞ্জ পৌর চত্বরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানালেন। কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দান এবং গ্রামের বাড়ি মাইজবাড়ীতে বিশাল মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা হলো। সুনামগঞ্জ সেদিন শোকের শহরে পরিণত হলো। গত বছর ১২ অক্টোবর বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করে তোমাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। কি যে ভয় লাগত আগস্ট থেকে অক্টোবর। আল্লাহ চার মাসও সময় দিলেন না। এক বছরের ওষুধগুলো এখনো টেবিলে। কত কষ্ট না পেয়েছ! মানুষ তখনো কত দোয়া করেছে। সারা দেশের মসজিদে দোয়া হয়েছে। তোমার প্রেসক্রিপশনটা এখনো মুখস্থ। কেমোথেরাপি দিতে কি যে কষ্ট হতো। আরেকদিকে সপ্তাহের লেখা এত কষ্টের মধ্যেও কীভাবে লিখে ফেলতে। শেষ দিনও লেখার জন্য চেষ্টা করেছিলে। লেখাটার জন্য বিপুল হাসান আঙ্কেল এসে ঘুরে গেলেন। তোমার লেখার মতো অবস্থা ছিল না, তুমি ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলে। লেখার জন্য কি যে আকুলতা ছিল তোমার। তুমি বলতে সাংবাদিকদের বন্ধু হয় না। যখন যার বিরুদ্ধে লেখা বা কথা যায় সে-ই মনঃক্ষুণ্ন হয়। আমরা যে এখনো চিন্তায় গণতান্ত্রিক হতে পারিনি। নঈম নিজাম আঙ্কেলের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব ছিল ব্যতিক্রম। মনে হলো আপন চাচার মতোই আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, ভরসা দিচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, শুধু বন্ধু না। ভাইকে হারিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অফিসে তোমার রুমটা এখনো সেভাবেই আছে। শুধু তুমি নেই। আমার যাওয়ার এখনো শক্তি হয়নি, চাচ্চু গিয়েছিলেন। শাবান মাহমুদ চাচাও ছিলেন তোমার ভাইয়ের মতোই, তাই ফোনে কথা বলতে গেলেই কেঁদে দেন। তোমাকে নিয়ে টকশো করেছেন। আমার তো তোমাকে নিয়ে কিছু পড়তে বা কোনো লেখা দেখলেই কান্না আসে।
গত দু-তিন বছরে নিজেকে টকশো থেকে দূরে রাখলেও আগে কত ঘন ঘন যেতে। এখন সেসব শুধু স্মৃতি। মানুষের জন্যই লিখতে চেয়েছিলা, অন্যায় সহ্য করতে পারতা না। তোমার শেষ বিদায়েও মানুষের ঢল। তোমার মনটা ছিল আকাশের চেয়েও বড়। কি সরলভাবে মানুষকে বিশ্বাস করতে তুমি। মানুষকে ভালোবাসতে যে জানতে হয় তা তোমাকে দেখেই শিখেছি। সবার জন্য কত মায়া, কত চিন্তা! কত বিশ্বাসঘাতকতা। অভিমান ছিল, দহন ছিল। কিন্তু চরম আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে ছিলে। সবকিছু হাসিমুখে করে ফেলতে পারতা কেমন করে?
ছোটবেলায় তুমি বিদেশ গেলেই একটা স্যুটকেসভরা শুধু আমার জন্য খেলনা থাকত। খেতে পছন্দ করতে তুমি। কিন্তু শেষ ক’মাস কিছুই খেতে পারতে না। অফিস শেষ করে প্রতিদিন রাতে আমার জন্য বাইরে থেকে খাবার আনতে। সে সময় ডেলিভারির ব্যবস্থা ছিল না। এত স্মৃতি কীভাবে লিখব?
বড় বড় মানুষের স্নেহ কুড়িয়েছ। আমাকে তিন বছর বয়সে গণভবন ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলে কোলে করে। আর ইংল্যান্ড যাওয়ার কিছুদিন আগেও নিয়ে গিয়েছিলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে। রাষ্ট্রপতি তোমার লেখার একজন পাঠক ছিলেন, তোমাকেও পছন্দ করতেন, স্নেহ করতেন। প্রয়াত সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তোমাকে স্নেহ করতেন। আমাকে কতবার তাঁর অফিসে নিয়ে গেছ। আমার অল্প অল্প মনে আছে আমি তাঁর চেয়ারে বসে বলেছিলাম কমফোর্টেবল, তিনি আমার জন্য চকোলেট রাখতেন। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের দিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তুমি রিপোর্ট করতে দেশের অনেক জায়গায় গিয়েছ, তিনিও তোমাকে স্নেহ করেছেন। তখন না বুঝেই বলতাম, প্রধানমন্ত্রী হতে চাই। তোমার কিছু সহকর্মী হেসে বলেছিলেন, ‘আপা ও বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চায়’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও হেসে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই হবে কিন্তু পড়াশোনা করে হতে হবে’। তুমি একবার রিপোর্টিং জীবনে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলে তিনি যখন দিল্লি সফর করে ঢাকায় ফিরছিলেন যে ঈদের শাড়ি কিনেছেন নাকি। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ’৭৫-এর পর তাঁর জীবনে ঈদ আসেনি। তোমাকে ছাড়া আমাদের ঈদ আসবে না।
তোফায়েল চাচুর বাসায় যেতাম, তিনিও আসতেন। এভাবে কখন জানি তাঁর সঙ্গেও একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে কত স্মৃতি। আমি ইংল্যান্ডে থাকতেও প্রায়ই ফোনে কথা হতো। ফোনে শিশুর মতো কাঁদছিলেন। আমু চাচা বিদেশ ছিলেন, জানিয়েছেন শিগগিরই দেখতে আসবেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক চাচা জানাজায় এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাসানুল হক ইনু, এনামুল হক শামীম, আহমদ হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল প্রায় সবাই এসেছিলেন জানাজায়। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাকে ছোটবেলায় বলেছিলেন তাঁকে দাদু বলে ডাকতে। তাই শেষবার পর্যন্ত দাদু বলেই ডাকতাম। ছোটবেলায় বিদেশ গেলে তিনি আমার জন্য খেলনা নিয়ে আসতেন। আমাকে নিয়ে কয়েকবার তাঁর বাসায় সকালের নাশতাও করতে গিয়েছ। আমাদের বাসার কোনো অকেশন তিনি মিস করতেন না। ২০১৮ সালে তিনি যখন সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন, আমি তাঁর সঙ্গেই হেলিকপ্টারে ঢাকায় এসেছিলাম। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু চাচার সঙ্গে তোমার মজার মজার স্মৃতি বলে হাসাতে। ন্যাপের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় মোজাফ্ফর আহমদ মৃত্যুর আগে সাদা কাগজে সাইন দিয়ে বলেছিলেন, তোমার কথাই নাকি তাঁর কথা। কারণ তুমি মানুষের কথা লিখ। এ রকম কত নাম শেষ করতে পারব না লিখে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সব দলমত নির্বিশেষে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। পেশার কারণে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু থেকেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক ছিল। যাঁদের অনেকেই আবার তোমার পাঠকও ছিলেন।
বাবা মানুষের জন্যই লিখতে চেয়েছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চেয়েছেন, মানুষের অধিকার যেখানে ক্ষুণ্ন হয়েছে সেখানেই তিনি আঘাত পেতেন। তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু যা বিশ্বাস করতেন তা লিখতেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস প্রখর ছিল। তাঁর ফেসবুকে শেষ স্ট্যাটাসের শেষ লাইন ছিল- ‘আল্লাহ আমাকে করুণা দাও’। চিন্তায় তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। যিনি সব ধর্মকে সম্মান করতেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভারতে তাঁর অনেক বন্ধু বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কত কথা হতো একসঙ্গে, আমি তো ঘুমাতে পারি না। মা যেন আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন আর চন্দ্রস্মিতা বলে, আমি তোমাকে কেন এনে দিতে পারি না? ছোট চাচ্চুর অস্থিরতা দেখি, আর আমরা ভাবতে থাকি কিছু কি ভুল করলাম। সে যেন সব হারিয়ে ফেলেছে। বিস্ময় আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। রৌদুসিও কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। চাচু আর ফুপি যেন মেনেই নিতে পারছেন না। নানু-নানি বলেন, আমার হাবিবটাও চলে গেল। চাচিরাও মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, তোমার সহকর্মীরা মর্মাহত। কত মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেলে। চন্দ্রস্মিতা বলে, পাপা ছিল জনগণের পীর ভাই। তাই পুরো জীবনই কেটেছে ব্যস্ততায়। শেষ জীবনটা কি সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলে। সুনামগঞ্জের জন্য তোমার কত টান। এই সুনামগঞ্জের কথা তোমার লেখায় টকশোয় সব সময় উঠে আসত। মানুষ বড় হলে শিকড় ভুলে যায়, এটাকে ভুল প্রমাণ করে সুনামগঞ্জকে অন্যরকম পরিচিতি দিয়েছ সারা দেশে।
লেখক : বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রয়াত নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমানের পুত্র।