এতো পরাধীন লোক কীভাবে সাংবাদিক হয়?
ফরিদ কবির-
আজকের কাগজ-এ থাকতে আমি সম্পাদকীয় পাতা সম্পাদনা করতাম। কতোই বা বয়স তখন? ৩০ বা ৩১? সে সময় প্রায়ই পত্রিকাটির প্রকাশক কাজী শাহেদ আহমেদ তার লেখা দিতেন ছাপানোর জন্য। পত্রিকার মালিক তার লেখা দিচ্ছেন, আর আপনি ছাপাবেন না, এতো ধৃষ্টতা আপনি এখন কল্পনাই করতে পারবেন না! এক বছর সময়ে শাহেদ ভাই গোটা পাঁচ-সাতেক লেখা আমাকে দিয়েছিলেন! লেখা দেয়ার দু-তিনদিন পর লাঠি হাতে এসে হাজির হতেন। বলতেন, ফরিদ কবির, তুমি কি আমার লেখাটা পড়েছো? আমি বলতাম, পড়েছি, শাহেদ ভাই। কিন্তু এই লেখা ছাপা হলে আপনারই বদনাম হবে। আপনি আরেকটা লেখা দেন। শাহেদ ভাই অপ্রস্তুত হতেন, কিন্তু সেই লেখাটা ছাপাতে জোর করতেন না। বলতেন, তাহলে আরেকটা লেখা দিচ্ছি। আমার মাথায় অনেক লেখা ঘুরছে। কালই আরেকটা লেখা পাঠিয়ে দিচ্ছি। না। যতোদিন আজকের কাগজে ছিলাম, কোনোদিনই তার কোনো লেখা আমি ছাপিনি।
ভোরের কাগজ-এ থাকতে আমার ভালো লাগেনি, এমন কোনো লেখা সম্পাদক মতিউর রহমান চাইলেও আমি ছাপাতাম না। তবে অনেক দিন এমন হতো, আমি পেস্টিং করে চলে আসার পর মতি ভাই কোনো একটি লেখা বদলে তার পছন্দমতো লেখা ঢুকিয়ে দিতেন। পরের দিন এটা নিয়ে তার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। আর, এ বিষয়টি ছাড়াও আরও কিছু বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে।এবং এক সময় আমি পত্রিকাটির চাকরি ছেড়ে দেই। শুধু আমি নই, আজকের কাগজে থাকতে আবু হাসান শাহরিয়ারকেও দেখেছি, সম্পাদক বা পত্রিকার মালিক বলে বিশেষ খাতির ও কাউকে করতো না।
আমরা তরুণ বয়সে জেনেছি, সাংবাদিকতাই স্বাধীন পেশা। একজন সাংবাদিক কাউকে তোয়াক্কা করেন না। আর, সে কারণেই এ পেশার প্রতি তীব্র আকর্ষণ জেগেছিলো। হ্যাঁ, সে সময় কাউকে তোয়াক্কা করিনি। সে সময় কোনো মন্ত্রীর আমন্ত্রণেও কখনো যাইনি। আমরা তখন জানতাম, সিনিয়র সাংবাদিক হলে ওসব মন্ত্রী-ফন্ত্রীদের পাত্তা দিতে নেই! অনেক মন্ত্রী-আমলা দাওয়াত করলে জুনিয়র কোনো সাংবাদিককেই পাঠিয়ে দিতাম। বলতাম, যাও, পাঁচতারা হোটেলে খেয়ে এসো।
এখন দেখি, সব সাংবাদিকই আমলা-মন্ত্রীদের দাওয়াতে যান। যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আহসান হাবীবের মতো সাহিত্য সম্পাদককে দেখেছি, সম্পাদক বলে শামসুর রাহমানকেও তিনি রেহাই দিতেন না।শুনেছি, পছন্দ না হলে তার লেখাও ফেরত পাঠিয়ে দিতেন! এখন প্রায়ই সাহিত্য সম্পাদকদের বলতে শুনি, স্বাধীনতা নেই বলেই তিনি মনমতো কাজ করতে পারছেন না!
এতো পরাধীন লোক কীভাবে সাংবাদিক হয়? কীভাবে সাহিত্য সম্পাদক হয়? পরাধীন মানুষ আসলে অর্ধমানব! সে না-সাংবাদিক, না-সাহিত্যিক, না-সাহিত্য সম্পাদক!
আমি হয়তো জীবনে কিছুই হতে পারিনি। কিন্তু পরাধীনতা সহ্য করিনি। যা কিছু করেছি, স্বাধীনভাবেই করেছি।কাউকে পরোয়া করে নয়।আজ পর্যন্ত লেখক বা কবি হওয়ার জন্য, কিংবা কোনো স্বীকৃতির জন্য কোনো পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাতিনি।আমি এটুকুই বুঝি, না চাইতে যেটুকু পাওয়া যায়, আমি তারই যোগ্য। যে লেখক-কবি স্বীকৃতির জন্য হাত পাতে, তাকে আমার ভিক্ষুক ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া