আহমেদ জামান শিমুল –

মাত্র সেদিনের কথা, পয়লা মার্চ। কালিকাপ্রসাদ এসেছিলেন ‘ভুবন মাঝি’র প্রিমিয়ারে। অল্প সময় কথা হয়েছিল তার সঙ্গে। পরিবর্তন ডটকমে কাজ করি শুনে বলছিলেন, ‘তোমাদের ওখানে তো শাহীন (কাজল রশীদ শাহীন) আমার একটা সাক্ষাৎকার করেছিল বিশাল করে। বেশ ভালো হয়েছিল।’ কথা দিয়েছিলেন পরেরবার এলে আবার সাক্ষাৎকার দেবেন। কিন্তু কথা রাখতে পারেননি এ শিল্পী। না, কথা রাখতে পারেননি বললে ভুল হবে। সড়ক দুর্ঘটনা তাকে বাঁচতে দিল না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা গান, বাঙালি সত্তা সবকিছুই তার আপন ছিল। লালন ও শাহ আবদুল করিমের বহু গান গেয়েছেন তিনি ও তার ব্যান্ড দোহারের সদস্যরা। এদেশে এসেছেন বহুবার। শাহ আবদুল করিম প্রসঙ্গে পরিবর্তনকে বলেছিলেন, “শাহ আবদুল করিমকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, লোকে আপনাকে বাউল বলে, আপনি নিজেকে কী মনে করেন? উনি তখন বলেছিলেন, ‘মানুষে কয়, আমি তো কই না। কেউ পাগল কয়, কেউ বাউল কয়।’ আমি বলব, শাহ আব্দুল করিম বাউল ছিলেন। বাউলদের তো একটা আলাদা জীবনযাপনের ব্যাপার থাকে, তাদের নিজস্ব কিছু রীতি-নীতি আছে, শাহ আবদুল করীমের তো সেটা ছিল না বা উনি পালন করতেন না।”

কালিকা প্রসাদ সে সাক্ষাৎকারে আরো বলেছিলেন, “আপনি (শাহ আবদুল করিমকে উদ্দেশ্য করে) আল্লাহকে বিশ্বাস করেন? বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তাহলে নামাজ পড়েন না যে? একথা বললে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এত ছোট নাকি যে তিনি আকাশ থেকে দূরবীণ দিয়ে দেখছেন আমি নামাজ পড়ছি কিনা! আল্লাহ অনেক বড় ব্যাপার। আল্লাহ অফিসের বস না।” এমনই মানুষ কালিকা প্রসাদ। রিমেক-রিমিক্সের এ যুগে শুধু শিল্পী বা কম্পোজার পরিচয়ে থাকতে চাননি, ভক্তি-মার্গে ছিল তার বিস্তর আগ্রহ। তাই বারবার ছুটে এসেছে বাংলাদেশে। শিলচরের ছেলে কালিকা জানতেন লোকসঙ্গীতের কোনো কাঁটাতার নেই, নেই ভাষা-বিভাজন। তাই একই পাতে পরিবেশন করতেন লালন, খাজা নিজামউদ্দিন ও শাহ আবদুল করিমকে। তার মাঝে ঢুকে পড়ত রামপ্রাসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘ভুবন মাঝি’র প্রিমিয়ারে বলেছিলেন, ‘আমার এখানে দুটো সত্তা। এক হলো ভারতবাসী, আরেক হলো বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধকে আমাদেরও ইতিহাসের অংশ মনে করি। আমার বাড়ি ঠিক কলকাতায় নয়। আমার বাড়ি শিলচরে। সেখানেই আমার বড় হওয়া। জন্মগতভাবেও আমি একাত্তরের সন্তান। ১৯৭১ সালেই আমার জন্ম।’ ‘ভুবন মাঝি’র সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কালিকাপ্রসাদ। দীর্ঘদিনের বন্ধুকে হারিয়ে ছবিটির পরিচালক ফেসবুকে লেখেন, ‘যার সুর আছে মৃত্যু তার কাছে ভিক্ষা মাগে। আজ ভুবন মাঝি কালিকা ভাই তোমাকে দিয়ে দিলাম।’ তিনি এ শিল্পীর শেষকৃত্যে অংশ নেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টার ফ্লাইটে কলকাতা যাচ্ছেন বলে জানান পরিবর্তনকে।

এদিকে সিনেমাটির অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আমার ভাষা নেই, শিকড় নেই, কথা নেই, নিঃশ্বাস নেই, গান নেই, গানের সুরও নেই, বন্ধু নেই, দাদা নেই, কলিকাদা নেই।’ এভাবে একে একে শোকলিপিতে অনুভূতির কথা জানিয়েছেন অনুপম রায়, সোমলতা আচার্য, সুরজিৎ, দেবজ্যোতি মিশ্র, ঊষা উত্থুপ, রূপঙ্কর, সৌরভ মণি, অভিজিৎ বসুসহ কলকাতার নামি-দামী শিল্পীরা। কাঁদছেন বাংলাদেশের অনেকে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে লিখেছেন, ‘কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্যের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমি স্তম্ভিত। কালিকা প্রসাদের মৃত্যু বাংলার সঙ্গীত জগতের জন্য বড় ক্ষতি।’ ‘ভুবন মাঝি’তে সপ্তর্ষীর কণ্ঠে কালিকা আমাদের শুনিয়েছিলেন— ‘আমি তোমারই তোমারই তোমারই নাম গাই। আমার নাম গাও তুমি। আমি আকাশে রোদের দেশে ভেসে ভেসে বেড়াই মেঘের পাহাড়ে চড়ো তুমি।’ আজ আমরা কালিকার নাম গাই, যিনি রোদের দেশে ভেসে ভেসে মেঘের পাহাড়ে চড়ে শুনছেন এ গান। যিনি রাখেননি কথা!

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn