উৎপল দাস।।

ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের এক বছর পার হলেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এ কাউন্সিলকে ঘিরে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর আশায়’ বুক বেঁধেছিলেন দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। কিন্তু পরবর্তীতে ওই কাউন্সিলে ঘোষিত দলের সিদ্বান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটির হাইকমান্ড। এমনকি দলীয় গঠনতন্ত্র বই আকারেও প্রকাশ করতে পারেনি তারা। তবে যে যাই বলুক ’বিএনপি ব্যর্থ’ একথা মানতে নারাজ দলটির শীর্ষ নেতারা। বরং ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার পরও বিএনপির ওই কাউন্সিলকে বড় সফলতা বলে মনে করছেন তারা।  তাদের দাবি পরিস্থিতি ‘অনুকূলে’ না থাকায় গৃহীত পরিকল্পনার বেশির ভাগ বাস্তবায়িত হয়নি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক বিএনপি নেতার দাবি, জাতীয় সম্মেলন হয়েছে কিন্তু দলের সাংগঠনিক ব্যর্থতার করণে সিদ্বান্তগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য রাজপথে আন্দোলনেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে একের পর এক জাতীয় ইস্যু হাতছাড়া হয়ে আন্দোলনের মাঠ থেকে ছিটকে পড়েছে দলটি। দলীয় সুত্রে জানা গেছে, কাউন্সিল-পরবর্তী কমিটি ঘোষণার এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্থায়ী কমিটির তিনটিসহ একাধিক পদ এখনো ফাঁকা। অঙ্গ-সংগঠন ও তৃণমূল পুনর্গঠন এখনো শেষ হয়নি। পাশাপাশি বিএনপিতে এক ব্যক্তির এক পদ গৃহীত নীতিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কেউ কেউ একাধিক পদ থেকে পদত্যাগ করলেও বেশ কয়েকজন বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে পদ আঁকড়ে আছেন। জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত দলীয় গঠনতন্ত্র বই আকারে প্রকাশ করতে পারেনি বিএনপি। কবে নাগাদ এটা হবে তা দলের কেউ বলতে পারছেন না। গঠনতন্ত্র প্রকাশ না হওয়ায় বিএনপির নির্বাহী কমিটি কত সদস্যবিশিষ্ট বা নতুন কী সংশোধনী আনা হলো, এর কিছুই জানে না নেতাকর্মীরা। প্রায় প্রতিদিন তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী নয়া-পল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গঠনতন্ত্র নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। এ জন্য ২০০৯ সালের পুরনো গঠনতন্ত্র ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। অনেক ক্ষেত্রে নতুন গঠনতন্ত্র না পাওয়ায় সাংগঠনিক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিভিন্ন পর্যয়ের নেতারা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে চাইলে তারা জানান, গঠনতন্ত্র এখনো ছাপা হয়নি। ২০০৯ সালের পুরনো গঠনতন্ত্র রয়েছে। কবে নাগাদ নতুন গঠনতন্ত্র পাওয়া যাবে তা তারা জাননে না। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত হয়েছে। এখন শুধু চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সই বাকি। আশা করছি, শিগগিরই গঠনতন্ত্র ছাপা হবে। এক বছর আগে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের খসড়া গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ছিল, মন্ত্রণালয় ভিত্তিক ২৬টি উপকমিটি হবে। প্রতিটি উপকমিটিতে সর্বোচ্চ ১২ জন সদস্য থাকবেন। কিন্তু ওই কমিটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। আদৌ ওই কমিটি হবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান দলের নেতা-কর্মীরা। এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কেউ জানে না। গঠনতন্ত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, দলের সদস্য ফি ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা করা হয়। কেউ মাসিক চাঁদা ৬ মাস না দিলে তার পদ স্থগিত করা হবে। আর এক বছর না দিলে পদ বাতিল করা হবে। আর টানা দুই বছর চাঁদা না দিলে তার প্রাথমিক সদস্য পদ স্থগিত করা হবে। তিন বছর না দিলে প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করা হবে। নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ১৭ থেকে ৩৫ জন। উপদেষ্টা পদ চেয়ারপারসন যত খুশি তত রাখতে পারবেন। সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতি বিভাগে একজন ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক থাকবেন প্রতি বিভাগে দুজন। কাউন্সিলে অনুমোদিত গঠনতন্ত্র ধরেই ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা, জেলা ও মহানগর কমিটির রূপরেখা তৃণমূলে পাঠানো হয়।

তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কাউন্সিল অনুমোদিত গঠনতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই মেনে চলছে না বিএনপি। স্বল্প পরিমাণে মাসিক চাঁদা দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ নেতাই মাসের পর মাস বকেয়া রাখছেন। গঠনতন্ত্র না থাকায় এ ব্যাপারে সাংগঠনিক বিধিও প্রয়োগ করতে পারছে না দলটি।

একাধিক নেতাকর্মীর জানান, সরকারের নানামুখী চাপের মধ্যেও বিএনপি সফল একটি কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে; কিন্তু সেই সফলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ সম্মেলনের সাড়ে চার মাস পর গত ৬ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসে। যা দলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কমিটি। স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদ, ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৫৯২ জনের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। গত এক বছরে এ বিশাল আকৃতির কমিটি কোনো সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেনি। বরং এতে পদবঞ্চিত ও অবমূল্যায়নের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট নেতাদের মাঝে দেখা দেয় ক্ষোভ। তাদের অনেকেই দলীয় কার্যক্রমে এখনও বেশ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। নেতারা আরো জানান, কাউন্সিলের লক্ষ্য ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার-নির্যাতনসহ নানা কারণে সৃষ্ট নেতাকর্মীদের হতাশা কাটিয়ে দলকে চাঙ্গা করা। এজন্য ওই সময় থেকে তৎপরতাও শুরু করে দলটি। কেন্দ্রের পাশাপাশি সারা দেশে জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠনের জন্য কয়েক দফা উদ্যোগও নেয় বিএনপি। তবে এখনো অর্ধেক সংখ্যক জেলায় কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়নি। বিএনপি পূনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটার কোন মেয়াদ নেই। যেখানে সমস্যা দেখে দেবে সেখানেই কাজ হবে। এটার শেষ নাই। টাইম ফ্রেম বেধে দিয়ে সাংগঠনিক কাজ হয় না। এদিকে এ কাউন্সিলের তেমান একটা প্রভাব পড়েনি বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর সিংহভাগে। দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি ঘোষণা নিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বছরের পর বছর। যা এখনো চলমান। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ ও হতাশা। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ৯টি ও সহযোগী সংগঠন ২টি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৪টি (স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলা দল ও জাসাস) এর আংশিক কমিটি দেয়া হয়েছে। বাকি রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষকদল, তাঁতি দল, মৎস্যজীবী দল, ওলামা দল, ছাত্রদল এবং শ্রমিক দল।

দলের অঙ্গসংগঠনের বিষয়ে গয়েশ্বর বলেন, প্রতিটি সংগঠনে কিছু প্রক্রিয়াগত ত্রুটি আছে। এছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে যার যে দায়িত্ব পালন করার কথা তা পারছে না। অনেকে আবার এসব কারণ দেখিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চায়। এদিকে কাউন্সিলের মাধ্যেমে দলকে যুগপোযোগী করার প্রত্যায় ব্যক্ত করা হলেও সংখ্যালঘু, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হাত ছাড়া করেছে বিএনপি। এ ছাড়া বিতর্কিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুললেও এ ইস্যুতে শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি বিএনপিতে। এমনকি কূটনৈতিক অঙ্গনেও দলটির কার্যক্রম চলে ঢিমেতালে। দলটির কূটনৈতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য শমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগ, ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা আর অন্য সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেও বাংলাদেশে সফররত বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দলটির চেয়ারপারসন।

অন্যদিকে কাউন্সিলে ঘোষিত বিএনপি চেয়ারপারসনের ‘ভিশন-২০৩০’ অগ্রগতি সম্পর্কে স্থায়ী কমিটি সদস্য (অব.) লে.জে. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনা একটি চমৎকার যুপোপযোগী উদ্যোগ, এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। চূড়ান্ত হলেই তা প্রকাশ করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন।’ দলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শামছুজ্জামান দুদু বলেন, আমাদের একটি চ্যালেঞ্জ ছিল দলীয় সম্মেলন করা। ১৯ মার্চ বিএনপি একটি সফল সম্মেলন করেছে। যদিও কমিটি গঠনে একটি দেরি হয়েছে। এছাড়া একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলছে। ২০১৭ সাল গণতন্ত্রের জন্য অগ্রগতির বছর হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn