কোন পথে ছাত্রলীগ?
লেখক : এমদাদ রহমান-
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় যে সংগঠনটি জন্ম নিয়েছিলো সেটি আজ ৭০ বছর পূর্ণ করলো। জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সকল লড়াই সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। বলা চলে বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে এই ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগের ৭০ বছরের এই দীর্ঘ পথচলার প্রায় পুরোটাই গৌরবের। মাঝেমাঝে কিছু ব্যতয় ঘটেছে যদিও। কিছু ব্যক্তিবিশেষের কর্মকান্ডের জন্যও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনকে। এমন গৌরবময় একটি সংগঠনের ৭০ বছর পূর্তিলগ্নে আত্মতুষ্টি তো আছেই; পাশাপাশি প্রয়োজন আত্মসমালোচনাও। খোঁজে দেখা প্রয়োজন ভেতরকার সঙ্কটগুলোও। আজ কোন পথে ছাত্রলীগ? বিশেষত সিলেট ছাত্রলীগ? গত ২০ বছরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের চারটি কমিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর মধ্যে দুই কমিটিতে দায়িত্বেও ছিলাম। ২০০২-২০১০ মেয়াদে সহ সম্পাদক ও ২০১১-২০১৩ মেয়াদে সহ সভাপতি পেদে দায়িত্ব পালন করেছি। সেই সুবাদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সিলেট জেলা কমিটির চারটি কমিটির নেতৃত্বের পালাবদল দেখার সুযোগ হয়েছে। ছাত্রনেতা হিসাবে অনেক মেধাবী ছাত্রলীগ কর্মীর সান্নিধ্যও পেয়েছি।
আমার দেখা সিলেট জেলা ছাত্রলীগের চারটি কমিটির মধ্যে তিনটি কমিটিই সম্মানজনকভাবে মেয়াদ শেষ করে বিদায় নিতে পারেনি। নানা কারণে মেয়াদ শেষ হবার আগেই কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। আর না হয়, সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন। কখনো কখনো গঠনতান্ত্রিক নিয়মে হয়ে উঠেনি নেতৃত্বের পালাবদলও। যা একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসাবে আমি মনে করি দুঃখজনক। এমন সংকটগুলো ঐতিহ্যবাহি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বর্ণাঢ্য অধ্যায়ে কালিমালেপন করেছে বলেই মনে করি। আর সাংগঠনিক এসব দূর্বলতার মাঝে কিছু বিপথগামীদের কর্মকান্ড বা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় গনমাধ্যমে নেতিবাচক খবরেরও শিরোনাম হয়েছে প্রাণের এই সংগঠন। অনাকাঙ্খিত হলেও অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ! তবে, ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও এডভোকেট নাসির উদ্দিন খানের নেতৃত্ব ছাত্রলীগ বীরদর্পে রাজপথ ধাপিয়েছে। দেশের রাজনৈতি পট পরিবর্তনে আসে অপারেশন ক্লিন হার্ট। তবুও সেসময় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সফলভাবে বিদায় নিয়েছিলেন নাদেল-নাসির জুটির নেতৃত্বাধিন সিলেট জেলা ছাত্রলীগ কমিটির সদস্যরা।
নানান প্রতিকূল পরিবেশে ২০০২ সালের ২৭ অক্টোবর ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারী মাঠের সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- আওয়ামীলীগের বর্ষিয়ান নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সুলতান মোহাম্মাদ মনসুর সহ সদ্য কারামুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি লিয়াকত শিকদার। সম্মেলনে ছাত্রলীগের অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি প্রকাশনাও করা হয়েছিল। তথ্য সমৃদ্ধ স্বরণিকাটি নতুন প্রজন্ম কাছে ব্যাপক প্রসংশিত ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংগঠনের নীতি আদর্শ সম্পকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছিল কর্মী সমর্থকদের। সফল সেই সম্মেলনের পর ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর ঘোষিত কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান ছাত্রনেতা জগলু চৌধুরী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আল-আমিনুল হক পান্না। পরবর্তিতে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে আল-আমিনুল হক পান্না দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। তার স্থলাবিশিক্ত হন ছাত্র নেতা ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী। তৎকালিন সময়ে বিরোধী দলে থাকাবস্থায় এই কমিটির যোগ্য নেতৃত্ব প্রশসংশিত হয় সবমহলে। আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ভিত্তি আরো মজবুত ও ছাত্র আন্দোলনের সংগ্রামে রাজপথে ছিল জেলা ছাত্রলীগের আধিপত্য।
এতো কিছুর পরও সাংগঠনিক নিয়মে ধারাবাহিক নেতৃত্বের পালাবদলে পিছিয়ে পড়ে প্রসংশিত এই কমিটি। দীর্ঘ ৮ বছরেও সংগঠনের সম্মেলন করতে ব্যর্থ হন তারা। আর এই ব্যর্থতার দায়ে ২০১০ সালে সেই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।
একই বছর অক্টোবরে সম্মেলন ছাড়াই ছাত্র নেতা পংকজ পুরকায়স্থকে সভাপতি ও ফরহাদ হোসেন খানকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি অনুমোধন দেন কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রানচাঞ্চল্য ফিরে আসে ছাত্রলীগ কর্মী সমর্থকদের মাঝে।
কিন্তু বিধিবাম। বেশি দিন টেকেনি এই কমিটিও। বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিতর্কের ঝড় উঠে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ফলাফল হিসাবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থকে বহিস্কার করা হয়। আবারো নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়।
পরে তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপুকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সংগঠনের নীতি আদর্শ বিরোধি কর্মকান্ডের অভিযোগে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই কমিটিও কেন্দ্র থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। অথ্যাৎ ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে বিদায় নিয়েছিলো নিপু-ফরহাদ জুটির নেতৃত্বাধিন কমিটির সকল সদস্যরাও।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগ আবারো পড়ে নেতৃত্ব শূন্যতায়। নেতৃত্বহীন অবস্থা থাকার ফলে সাংগঠনিক ভিত্তিও কিছুদিন নড়বড়ে ছিলো। প্রায় ১ বছর পর ২০১৪ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন তরুণ ছাত্র নেতা শাহরিয়ার আলম সামাদ ও এম রায়হান চৌধুরী’। এবারও সম্মেলন ছাড়াই অসম্পূর্ণ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক হন রায়হান। তাদের নেতৃত্বে এক বছর ছাত্রলীগ সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় ছিল; পড়তে হয়নি কঠিন সমালোচনার মুখে। ফলে বছরান্তে আসে পুর্নাঙ্গ কমিটিও। কিন্তু পুরণো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি এই কমিটিও। আবারো নানান সমালোচনায় পড়ে জেলা ছাত্রলীগ! কখনো কমিটি স্থগিত, আবার কখনো স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার! এভাবেই চলে কিছুদিন।এমন অবস্থার মধ্যেই কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উপজেলা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কলেজ) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন সম্পন্ন করেন তারা। এর ফলে তৃনমূলে ছাত্রলীগ কর্মীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিলো যেমন, তেমনি অনেক জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কমিটিতে পদায়নের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের নাম সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠে। এমন অবস্থায় ঘটে যায় বিচ্ছিন্ন ও দুঃখজনক কয়েকটি ঘটনা। বিশেষ করে ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদ হত্যাকান্ড সবকিছু উলটপালট করে দেয়। কর্মী হত্যার প্রতিবাদে যার নেতৃত্ব দেবার কথা সেই সাধারণ সম্পাদক রায়হানের বিরুদ্ধে উঠে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ। মিয়াদ হত্যা মামলার আসামীও হন সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আবারো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ফলে এই নেতৃত্বও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিদায় নিতে পারেননি। নেতৃত্বের পালাবদলের দায়িত্বও পালন করতে ব্যর্থ হন তারা!সবমিলিয়ে আমার আত্মপোলব্দি খুব যে সুখের নয়, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্ররাজনীতিতে অতীতেও বিশৃঙ্খলা ছিলো; এখনো আছে! কিন্তু আগে সঠিক, দক্ষ নেতৃত্ব সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। যা এখন সম্ভব হচ্ছে না। বৃহৎ এই সংগঠনের দু-একজন কর্মীর বিপথগামীতা বা অপকর্মের দায় মাথায় নিয়ে একেকটি কমিটির লজ্জাজনক বিদায় হতাশার।
এমন বিদায়ে জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকা অনেক মেধাবী ও পরিচ্ছন্ন ছাত্রনেতাকে হারানোর দায় কে নেবে? এখানে ব্যক্তির চেয়ে বেশি ক্ষতি সংগঠনের। সুতরাং বিশৃঙ্খলাকারিদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে সাংগঠনিক ঐতিহ্যের ধারাকে। “শিক্ষা, শান্তি প্রগতি”র মিছিলের সিলেট জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একজনের অপরাধের দায় সবাই কেন নিবে? এই প্রশ্ন যথাযথ বলেই আমি বিশ্বাস করি।তবে, হতাশার পাল্লা যতই ভারি হউক না কেন, অর্জনও কিন্তু কম নয়। সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও বাংলাদেশ আওয়ামীগের রাজনীতিতে ছাত্রলীগ নিয়ামক শক্তি হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। সরকারের অর্জন সাধারণের দূরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ছাত্র সংগঠনটি রাখছে ধারাবাহিক ভূমিকা। দলীয় সকল আন্দোলন সংগ্রাম ও প্রচারনায় সিলেটের রাজপথে ছাত্রলীগ সবসময় তাদের জীবনবাজি রেখে প্রত্যেকটি কর্মসূচীতে সক্রিয় ছিল এবং আছে। পাশাপাশি ছাত্রজনতার অধিকার বাস্তবায়নে রেখে চলেছে যৌক্তিক ও সময়োপযোগি ভূমিকা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হলে মাঠের রাজনীতির পাশাপাশি চাই মেধাভিত্তিক ও বিজ্ঞান মনস্ক রাজনীতির চর্চা। ’বিশ্বমানবতার মা’ দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন তখন ছাত্রলীগকেই তার ভ্যনগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে ছাত্রলীগই পারে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা’র স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। হাল ছেড়ে দিতে নয়; আরো বলিষ্ট ও নীতি আদশের ধারক হয়ে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি কমী সমথকই যেন কাজ করতে পারেন সেই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যৎ উজ্জল নেতৃত্বের। প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তথা সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সকল সমালোচনার উধ্বে উঠে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিক অনাদি কাল, সেই প্রত্যাশা সবার কাছে।
এমদাদ রহমান, রাজনৈতিক কর্মী, সাবেক ছাত্রনেতা।