খালেদা জিয়ার উপর মামলার চাপ বাড়ছে
আলমগীর হোসেন : বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ওপর মামলার চাপ বাড়ছে। গত এক বছরে হত্যা, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও নাশকতাসহ ২১টি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুর্নীতি, নাশকতা, মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ৩২টি মামলা চলছে। এসব মামলার মধ্যে পাঁচটি দুর্নীতির অভিযোগে করা। বাকিগুলো সহিংসতা, হত্যা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা। দুর্নীতির পাঁচ মামলাই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দায়ের করেছিল। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি মামলা সচল রয়েছে। হত্যা ও নাশকতার মামলা চলছে ১৪ টি। রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা ১১ টি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মামলাগুলোর কোনোটি চলছে দ্রুতগতিতে, কোনোটি মন্থর গতিতে। খালেদা জিয়াকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে আদালতে যেতে হচ্ছে। কোনো কোনো সপ্তাহে দুই বারও ডাক পড়ছে হাজিরার। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য গত ১৩ এপ্রিল দিন ধার্য ছিল। ওইদিন ঢাকার বকশীবাজারের আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদ্দারের আদালতে চলা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা বদলি চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। পরে আবেদনটি মঞ্জুর করে এই বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ আনার জন্য বিচারক ১৮ মে নতুন তারিখ ধার্য করেন।
এর আগে গত ৮ মার্চ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলাটি ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ আদালতে (মহানগর দায়রা জজ) বদলির আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ সময়সীমাকে বিএনপির ওপর নতুন চাপ বলে কেউ কেউ মনে করলেও দলটির নেতা ও আইনজীবীরা চাপ মনে করছেন না। এই প্রেক্ষাপটে মামলা ও সম্ভাব্য রায় নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের আগ বাড়িয়ে দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতিতে বিরক্ত বিএনপির হাইকমান্ড। রায়ে কি হবে বা রায়ের পরে কি করা হবে তা নিয়ে নেতাদের অতিরঞ্জিত কথা-বার্তা বলতে নিষেধ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
সম্প্রতি তিনি কয়েকজন সিনিয়র নেতার সাথে বৈঠকে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলাই রাজনৈতিক এবং তা হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এসব মামলা করা হয়েছে। এ নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। আমি ন্যায়বিচার আশা করি। নিরপেক্ষ বিচার হলে এইসব মামলায় কিছু হবে না।’ দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘হাইকোর্টের এ আদেশে আমরা খুশি। কেননা, বিচারিক আদালত একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। এ আদেশ মানা অত্যাবশকীয়। আমরা বিচার চাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আপিল করার প্রয়োজন নেই।’
ওই মামলার একটি অংশের অভিযোগ পুনঃ তদন্ত চেয়ে খালেদা জিয়া বিচারিক আদালতে আবেদন করেন। এ আবেদনের শুনানি ও নিষ্পত্তির আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি বিচারিক পর্বে ৩৪২ ধারার বিধান অনুসারে কার্যক্রম শুরু হলে আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। ওই দিন তা খারিজ হয়। এরপর বিশেষ জজ আদালত-৩ থেকে মামলাটি অন্য আদালতে বদলির জন্য গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। এতে মামলাটি কেন ওই আদালত থেকে অন্য আদালতে বদলির নির্দেশ দেওয়া হবে না, এ মর্মে রুল চাওয়া হয়। ঢাকা-৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে মামলাটি বিচারের শেষ পর্যায়ে ছিল। একই আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারকাজ চলছে। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা করে দুদক।
খালেদা জিয়ার ছয় মামলা স্থগিত
নাশকতার অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আরো ছয় মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মামলার অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেছেন আদালত। বিরোধী দলীয় জোটের ডাকা হরতাল চলাকালে মিরপুরের দারুসসালাম ও যাত্রাবাড়ী থানায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে নাশকতার অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়। এ সব মামলায় খালেদা জিয়াকে ইন্ধন দাতা হিসেবে উল্লেখ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। পরে অভিযোগ আমলে নেয় আদালত। এই অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। দুটি মামলা অভিযোগ গঠন প্রশ্নে শুনানির জন্য ধার্য রয়েছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কার্যক্রমও স্থগিত করেন হাইকোর্ট। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মামলাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই চালিয়ে নেবেন তারা। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মামলায় রায় নিয়ে দলের চেয়েও বেশি চিন্তা সরকারের। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে মামলাগুলোর তেমন ভিত্তি ও আইনি জোর নেই। মামলার রায় নিয়ে আমরা চিন্তা করি না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক। তাকে জেলে রাখার ঝুঁকি সরকার নেবে বলে মনে হয় না। আমরা আইনের পথেই তার মামলাগুলো মোকাবিলা করব। খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, খালেদা জিয়ার নামে এখন ৩২টি মামলা চলছে। তার মধ্যে ২১টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সঠিক বিচার হলে এসব মামলার একটিও টিকবে না।