চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ-হাসান হামিদ
হাসান হামিদ-
আমরা বাঙালিরা আর যাই হোক, নিজের ঢোলখানি নিজে পিটিয়ে ফাটিয়ে দিতে ওস্তাদ। নিজে অপকর্ম করে, ঘুষ খেয়ে ঢেঁকুর তুলে অন্যের বদনাম করা আমাদের রক্তেই মিশে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ মিল্বে না; মিল্বে না কারণ আমরা সে চেষ্টাই করি না। ঢাকা শহরের যে পাড়ায় আমি থাকি, তার মোড়ে একটি সাইনবোর্ড বড় করে টানানো, যাতে লেখা ময়লা ফেলবেন না। কিন্তু সাইনবোর্ডের নিচেই ময়লার স্তূপ। আর এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। হয়তো আপনার আশেপাশেও হররোজ তা দেখে দেখে আপনিও অভ্যস্ত। তা বলি কি ভাই, এসব আলোচনা করে, এসব নিয়ে লিখে লাভ নেই! আসলেই কি তাই? না, কখনোই তা নয়। এই শহরের, এই সমাজের কিংবা এই দেশের পরিবর্তন আমাদেরই আনতে হবে। হাল ছেড়ে, দেশকে নোংরা গাল দিয়ে এ মাটির কতোটা লাভ হবে যদি কিছুমাত্র না কাজ করে যাই আমরা? আমরা নিজের ঘরকে পরিচ্ছন্ন করে যে যেভাবে পারি সেই ময়লাটুকু যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে আসি। আমরা কি একবারও ভাবি যে, এই শহর যদি নোংরা থাকে তবে আমার ঘরে ঝকঝকে লোমশ কার্পেট আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা শুধু আমাকে সুখী করতে পারবে না। কেননা আমাকে রাস্তায় বেরুতে হবে। তাহলে?
আদিবাসী আমেরিকানরা একটি প্রবাদকে কায়মনোবাক্যে স্বীকৃতি দেয়- ‘আমরা পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পৃথিবীর উত্তরাধিকার পাইনি। বরং অনাগত প্রজন্মের কাছ থেকে ধার করেছি।’ এই প্রবাদের সারকথা এমন হতে পারে যে, স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি, এ পৃথিবীর কোনো রকম ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই, বরং মানুষ এর একজন রক্ষক মাত্র। তবে পরিবেশ বিনষ্ট তথা দূষণের মাত্রা দেখলে মাঝেমধ্যে খেই হারাতে হয়। প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে থেকে অশিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে পরিবেশের প্রতি যে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পৃথিবীর অনেক শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এর সুফল ভোগের পরও নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধের সেই প্রেরণা খুঁজে পায় না। তাই নিজেরটুকু বুঝে নিয়ে ইচ্ছামতো দূষিত করে পরিবেশ। অথচ দূষণমুক্ত পরিবেশে বসবাস করার অধিকার আজ একটি সর্বজন স্বীকৃত মানবাধিকার। তবে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক দলিলপত্রেই শুধু নয়, আঞ্চলিক সমঝোতা, ঘোষণা কিংবা চুক্তিপত্রেও এ অধিকারের অস্তিত্ব লক্ষ্ করা যায়।
পরিবেশগত মানবাধিকারের ধারণা এখন বিভিন্ন দেশের সংবিধানেও স্থান পাচ্ছে। কনভেনশন অন রাইটস টু চাইল্ডের (১৯৮৯) ২৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রোগব্যাধি ও অপুষ্টি মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণের সময় পরিবেশের ক্ষতি ও ঝুঁকির কথা মাথায় রাখতে হবে।’ এডিশনাল প্রটোকল টু দ্যা ইন্টার আমেরিকান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের (১৯৯৪) ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন ধারণের অধিকার রয়েছে।’ আফ্রিকান চার্টার অন হিউমার এ্যান্ড পিপলস রাইটসের ১৯৮১ ২৪ (১) অনুচ্ছেদে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সাধারণভাবে সন্তোষজনক পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন নম্বর ৪৫/৯৪-এ ঘোষণা করা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই তার জন্য সহনীয় এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার অধিকারী।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে, তাবৎ বিশ্বের সংবিধানগুলোয়ও এই মানবাধিকারের ধারণা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এবার দেশের কথায় আসি। বাংলাদেশে বর্তমানে পরিবেশ বিষয়ক আইন কার্যকর থাকলেও সংবিধানে পরিবেশ নিয়ে সরাসরি কোনো কিছু বলা হয়নি। তবে ৩১ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, শরীর, সুনাম ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রদান করা হয়েছে যাতে বৃহৎ অর্থে দূষণমুক্ত পরিবেশ লাভের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে ওয়াটার পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স জারি করা হলেও মূলত এর পর থেকেই বুড়িগঙ্গার পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত ও দুর্গন্ধময় হচ্ছে। এই নদীটির দু’তীরে অসংখ্য কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে। টোকাই, ভবঘুরে এবং নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এ নদীর পানিতে গোসল করছে, খাচ্ছে, রান্নাবান্নায় ব্যবহার করছে আর আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে এই দূষিত নদী। মামলাও হচ্ছে না কারো বিরুদ্ধে। ১৯৭৭ সালে করা হয়েছে এনভায়রমেন্ট পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স।
আমি খোঁজ করে দেখলাম, বাংলাদেশে পরিবেশসংক্রান্ত একগুচ্ছ আইন আছে। পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত আইনের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। পরিবেশ আদালত শুধু বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর অধীন অপরাধগুলোর বিচার এবং ক্ষতিপূরণের দাবি বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে। সহনশীল পরিবেশ বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন পরিবেশ দূষণ আইন প্রয়োগ করা। পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৭০ সালে ‘পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ জারি করা হলেও ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত হয়েই চলেছে। চারদিক থেকে মানুষের সাঁড়াশি আক্রমণে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়, মামলাও হচ্ছে না কারো বিরুদ্ধে। ১৯৭৭ সালে করা হয়েছে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন; কিন্তু বিধিবাম। এরপর ধারাবাহিক আরো কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। দূষণ রোধে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ১৯৯৭ সালে পরিবেশ দূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনের ২ ধারায় পরিবেশ দূষণের দীর্ঘ একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে পরিবেশ দূষণ বলতে মাটি, পানি ও বায়ুর দৈহিক, রাসায়নিক বা জৈবিক দূষণ ও পরিবর্তনকে বোঝাবে এবং যার মাধ্যমে এগুলোর তাপমাত্রা, স্বাদ, ঘনত্ব বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয় সেগুলোও দূষণের অন্তর্ভুক্ত হবে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্পের গাড়িগুলোই সব থেকে বেশি দূষিত কালো ধোঁয়ার নিঃসরণের সঙ্গে জড়িত। তবু পুলিশ থাকে নির্বিকার। জরিমানা করার বা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। যদি আইনের বাস্তবায়নই না হয়, তবে কাগজ-কলমে আইনের ধারাগুলো থেকে তেমন লাভ আছে কী?
পরিবেশ আদালত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিচারিক আদালতে বিশেষায়িত পরিবেশ বিচারব্যবস্থা চালু করা হয় ১৭ বছর আগে ২০০০ সালে। দেশের প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত এবং সারাদেশের জন্য এক বা একাধিক পরিবেশ আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয় আইনে। পরিবর্তনের হাওয়ায় আগের আইনটি রহিত করে ২০১০ সালের পরিবেশ আদালত আইন নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। মজার ব্যাপার, পরিবেশ আদালত আইনে জনগণকে সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জনগণ কর্তৃক সরাসরি পরিবেশ আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ এ বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শকের লিখিত রিপোর্ট ছাড়া কোনো পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কোনো ক্ষতিপূরণের দাবি বা কোনো অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করবে না। পরিবেশ আদালত যেহেতু বিশেষায়িত বিচারিক আদালত, পরিবেশসংক্রান্ত অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করাই যার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশ আদালতে বিদ্যমান ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইন অনুসারে বিচারকাজ পরিচালনা করার জন্য পৃথক কার্যপ্রণালি বিধিও তৈরি করা হয়নি। ফলে দেখা যায় বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা আর মামলার জট।
তবে কিছু আশাব্যঞ্জক নীতিমালা পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় পরিবেশ নীতি (১৯৯২), জাতীয় পরিবেশ অ্যাকশন প্ল্যান (১৯৯২), বননীতি (১৯৯৪), বনায়ন মাস্টার প্ল্যান (১৯৯৩-২০১২) ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি) এবং বিশেষত জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা অ্যাকশন প্ল্যান সবার সহযোগিতায় প্রণীত হয়েছে। উপরন্তু ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে বিভিন্ন সামাজিক শক্তিসহ সরকারি বিধি ও নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন নীতিগত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে যদিও সবক্ষেত্রে ফলাফল মিলছে না। অন্যান্য বিবেচনা ছাড়াও নীতিমালার লক্ষ্য পরিবেশের উন্নয়ন। যেমন: শহর সৌন্দর্যকরণ কর্মসূচি, বিনোদন, এবং প্রতিবেশ ল্যান্ডস্কেপ, বন্যপ্রাণী ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ। পরিবেশ নীতির ৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে আইনগত রূপরেখা যাতে বর্তমান সময়ের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত নতুন আইন প্রণয়ন এবং সব আইন ও বিধান সংশোধন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয়রোধ প্রভৃতি বিষয় শর্তাবদ্ধ হয়েছে। পরিবেশ নীতির ৫ অনুচ্ছেদে রয়েছে নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাবলি। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পরিবেশ নীতি বাস্তবায়ন সমন্বয় করবে; সার্বিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য সরকারপ্রধানের সভাপতিত্বে একটি জাতীয় পরিবেশ কমিটি গঠিত হবে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সব পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন চূড়ান্তভাবে পর্যালোচনা ও অনুমোদন করবে। ব্যান্ডদল রেনেসাঁর গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে চাই- ‘আজ যে শিশু, পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো পৃথিবী চাই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপে দেখা যায়, হাজারীবাগ ট্যানারী থেকে দিনে ২২ হাজার ঘনমিটার আর বছরে ৮০,৩০,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। যা পরিবেশের ৪০,১৫,০০,০০০ টাকার ক্ষতি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যায়,বাংলাদেশ বায়ু দূষণের দিক থেকে প্রথম। কেবল ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা ৭৭.২৭ ভাগ। বর্তমানে ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ প্রতি ঘণমিটারে ৪৬৩ নেনোগ্রাম যা মানমাত্রার চেয়ে ১০ গুন বেশি। পরিবেশ দূষণ ঠেকানোর জন্য ঢাকা ও চট্রগ্রামে দুটি পরিবেশ আদালত রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আদালত দুটোতে মামলা নাই। নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত দের বছরে ঢাকার পরিবেশ আদালতে মাত্র ১৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশ আপিল আদালতে গত দুই বছরে মাত্র ৫টি আপিল শুনানি হয়েছে যার কোনোটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। পরিবেশ আদালত আইনের ৪ ধারায় বলা আছে- সরকার প্রতিটা জেলায় একটি করে পরিবেশ আদালত গঠন করবে। যারা সাধারণ ফৌযদারি ও দেওয়ানি মামলা বিচারের পাশাপাশি পরিবেশ অপরাধ মামলার বিচার করবে। কিন্তু এ যাবৎ মাত্র দুটো পরিবেশ আদালত হয়েছে-ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তবে আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন ‘পরিবেশ আদালতের জুরিস্ডিকশন কম, রিলিফ দেওয়ার ক্ষমতাও কম, অনেক ধাপ পেরিয়ে মামলা করতে হয়, যেটা সময় সাপেক্ষ’।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’র ১৭ ধারায় উল্লেখ আছে-ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পরিবেশ আদালতে সরাসরি মামলা করতে পারবে। তারপরও আদালতে মামলার পরিমাণ কম কেন? পরিবেশ আদালত আইন ঘেটে দেখা যায়, ৭(৪) ধারায় বলা আছে-পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ করার ৬০ দিন পর আদালত মামলা আমলে নিতে পারবে, এর আগে নয়। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০০৯’র তফসিলে উল্লেখ আছে-পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের কেবল ২টি ধারা [১৫এ(৩-৪ঘ)যানবাহন দূষণ ও পরিবেশ দূষক সামগ্রী বিক্রয় ব্যাপারে] ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার করতে পারবে। পরিবেশ নিয়ে বাকি অপরাধের বিচার পরিবেশ আদালত করবে। তাহলে সমস্যটা কোথায়? আদালতে মামলা আসছে না কেন? সচেতনতার অভাব। মানুষ জানেইনা পরিবেশ দূষিত হলে মামলা করা যায় এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে এমন একটি আইন হলো ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫। আইনটির ৪ নম্বর ধারায় বিধান করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেসে কিংবা পাবলিক পরিবহনে ধুমপান করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লংঘন করলে তিনি অনধিক ৫০ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন। এই আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শোনা যায় যে, কোনো পাবলিক প্লেসে বা পাবলিক পরিবহনে কাউকে ধুমপানের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাহলে কি ধুমপান সবাই ছেড়ে দিয়েছে? নাকি আগে থেকেই বাংলাদেশে কেউ ধুমপান করতো না? আসলে ঘটনা আমরা সবাই নিজ চোখেই দেখছি।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখীন। যেমন ফ্যাপ-২০ মামলার পর সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে, এসব সব কাজের দিকে সরকার কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করলেও ব্যক্তিগত বা বিভিন্ন কোম্পানি বা ডেভেলপারের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন সব কাজ এখনো বন্ধ হয়নি। এর প্রমাণ ব্যক্তি উদ্যোগে এবং ডেভেলপারদের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে জলাভূমি ভরাট, বন কেটে উজাড় করা, যা এখনো আমাদের আশেপাশে প্রতিদিনই ঘটে চলেছে। ঢাকা শহরের প্রাণ আশুলিয়া আর বুড়িগঙ্গা প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুদের হাতে। কোনো বিষয়ের উপর আইন প্রণয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। আইনের সুষ্ঠু ও সুষম প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নই ওই আইনকে পরিপূর্ণ করে। আবার এই সুষ্ঠু প্রয়োগ সরকার কর্তৃক জোর করে চাপিয়ে দিলেও চলবে না, জনগণের সহনশীলতার সীমায় থাকতে হবে।
বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে যত্রতত্র মাইক বাজিয়ে রাজনৈতিক সভার প্রচারাভিযান ও রাজনৈতিক সভা করা হয়। মানবাধিকারের ধারণা আজ শুধু মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রাপ্তির অধিকারটিও। শুধু আজকের নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। নইলে পৃথিবীর বুকে এক সময় প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়বে। আর এর জন্য কাগুজে আইন নয়, প্রয়োজন আইনের সঠিক বাস্তবায়ন।
(লেখক- তরুণ গবেষক ও কবি)