ছাত্রলীগ: বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়!
জুয়েল রাজ –বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, নিজেই একটি ইতিহাসের নাম। বাংলাদেশ নামের পাশে চির অম্লান চির ভাস্কর থাকবে যে নামটি তার নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলে ও যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তাঁদের ইতিহাস ঘাঁটলে ও দেখা যায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতেই তাঁদের রাজনীতির হাতেখড়ি। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয়দফা, গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন সবকিছুর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের পরতে পরতে মিশে আছে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের আন্দোলন আর ত্যাগের ইতিহাস। অস্থির সময় ছাত্ররাজনীতির ব্যাকরণ বদলে যাওয়ার কারণে, অথবা রাজনীতির মৌলিক ধারণা বদলে যাওয়ার কারণে শুধু ছাত্রলীগ নয় সব ছাত্র সংগঠনই সেই অবস্থান থেকে দূরে সরে এসেছে। বাংলাদেশের সাবেক নেতারা তাদের বক্তব্যে প্রায়ই বলেন, ছাত্রলীগের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনতে হবে।
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও কমিটি দেয়া সম্ভব হয়নি। ছাত্রলীগের ৭০ বছরের ইতিহাসে এটাই মনে হয় প্রথম ঘটনা। অকূল পাথারে যেন ছাত্রলীগ। লাগাম টেনে ধরার কেউ নাই। সাংগঠনিকভাবে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবক। কিন্তু এবারের ছাত্রলীগের সম্মেলন পরবর্তী ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে তিনিই যেন ছাত্রলীগের কাছে অসহায়! নিকট অতীতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্বিত করেছেন, বা দ্বিধাজনক অবস্থায় তিনি পড়েছেন বলে কোন ঘটনা মনে পড়েনা। আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনে প্রায় নিশ্চিত ছিল যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তৃতীয়বারের মতো দলটির সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন সেখানে সম্মেলনস্থলেই নাম ঘোষিত হয়েছিল বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এবং সৈয়দ আশরাফ নিজেই সেই নাম প্রস্তাব করেছিলেন। অথবা শেখ হাসিনা সেটি করিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগে এসে তিনি করতে পারেন নি। এইবার ছাত্রলীগের সম্মেলনের আগেই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ছাত্রলীগকে সিন্ডিকেটের বাইরে নিয়ে আসব। আর এইখানেই জট লেগে গেছে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি। শেখ হাসিনা নিজে যেখানে বলেছেন, ছাত্রলীগে আমার পছন্দের প্রার্থী আছে এরপর আর কোন কথা থাকার কথা ছিলো না। তাদের মেনে নেয়ার কথা ছিল। শেখ হাসিনার প্রার্থীই ছাত্রলীগের প্রার্থী।
ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচনের সময় তিনি অকালপ্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে নিয়ে এই বাজি ধরেছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করেন নি সেদিন। কারণ শেখ হাসিনার প্রতি অন্যান্য নেতাদের আস্থা এবং বিশ্বাস ছিল। তবে কি ছাত্রলীগের সেই আস্থা বিশ্বাস নেই? আমার ধারণা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে প্রাপ্ত ধারণা থেকে বলতে পারি তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রাণের দাবিই শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনায় আস্থা রেখেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মীগণ, কিন্তু আস্থা রাখতে পারছেন না সিন্ডিকেট। বছরের পর বছর ধরে ছাত্রলীগকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন সাবেক কিছু নেতা। যাদের আশীর্বাদ ছাড়া এখনো বাংলাদেশের ছাত্রলীগে কোন জেলা উপজেলা কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জো নেই। সবকিছু বাদ দিয়ে শেখ হাসিনাকে নির্ভর করতে হচ্ছে ডিজিএফআই, এনএসআই-এর প্রতিবেদনের ওপর। সর্বশেষ যা জানা যায় সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন আসলেই কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হবে। সবচেয়ে ভয়ংকর যে খেলাটি এক সপ্তাহ ধরে চলছে সেটা হচ্ছে ছাত্রলীগের আন্তঃকলহ। চরিত্র হনন, জামায়াতপন্থী বানানোর প্রক্রিয়া।
গণভবনে ফাইল থাকার পরও হঠাৎ করেই সংবাদ মাধ্যমে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দুইজনের নাম চলে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই শুভেচ্ছা ও জানানো শুরু করেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে সংবাদ ও প্রকাশিত হয়। এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরপরই আবার শুরু হয় বিরূপ প্রচারণা। কোন নেতার দাদা রাজাকার, কোন নেতা মদ্যপ, কোন নেতা ব্যবসায়ী এই সব। এবং যারা এই সংবাদগুলো প্রচার করছেন শেয়ার দিচ্ছেন তারা সবাই ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক অথবা বিভিন্ন জেলা উপজেলা বা বিদেশি ইউনিটের নেতাকর্মী। শুধু যে এই দুইজনের নামে হচ্ছে তা না। যাদের নাম সম্ভাব্য তালিকায় আসছে সবাইকে নিয়েই এই জাতীয় নোংরা খেলা চলছে এবং সেটা ছাত্রলীগই করছে। যাদের নাম সংবাদ মাধ্যমে আসছে তারা সবাই দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিতে ছিলেন। তাহলে এদের দায় বিদায়ী কমিটি বা সিন্ডিকেট কমিটি কি এড়াতে পারবেন? কারণ আপনাদের হাত ধরেই শিবির থেকে ছাত্রলীগে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই নেতারা। সদ্য বিদায়ী কমিটি তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের রাতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে পৃথিবীর সব দেশ সহ বাংলাদেশের যে সব জায়গায় কমিটি ছিল না সেসব কমিটি ও নাকি বেশিরভাগ ঘোষণা করেছেন। এর কারণ, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি হয় তাহলে যেন তাদের পছন্দের প্রার্থী জয়ী হয়ে আসতে পারেন। মানে সিন্ডিকেটের প্রার্থী যারা। আর এইই সমস্ত কাদা ছোড়াছুঁড়ির মূল যে কারণ হতে পারে সেটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করা। যাতে করে প্রধানমন্ত্রী আবার সেই সিন্ডিকেটের হাতেই সব ছেড়ে দেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এমন কোন সাফল্য কি ছাত্রলীগের আছে? আমার জানামতে নাই। বরং বারবার আওয়ামী লীগকে বিব্রত করেছে ছাত্রলীগ। যার কারণে প্রধানমন্ত্রী একবার রাগ করে বলেছিলেন আমি আর ছাত্রলীগের সাথে নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতির বর্ণাঢ্য ইতিহাসকে মমি বানিয়ে, সংগঠনকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন এর নেতারা। ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক নেতা যদি বছরের পর বছর ইউরোপ আমেরিকায় তারেক জিয়ার মতো বিলাসী জীবন কাটাতে পারে, তাহলে অনুমান করা যায়, ছাত্ররাজনীতির বাণিজ্যিকরণ নিয়ে সেই সন্দেহ অমূলক হওয়ার কথা নয়। কথাটা কিছু রূঢ় শোনালে ও বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ, সরকার কিংবা বাংলাদেশ এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাই শেষকথা। কারণ শেখ হাসিনা নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যদিও গণতন্ত্রে এমন ধারণা সুন্দর না। কিন্তু বাস্তবতা এটা। শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। মানবতা বিরোধী বিচারে সেই দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছেন। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের আল্টিমেটাম নিয়েও বলেছেন আল্টিমেটামে তিনি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না। অতএব ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে যারা বাজি খেলছেন তারা বোকামি করছেন।
বাঁশের ছেয়ে কঞ্চি বড় হওয়ার কোন ইতিহাস নাই।-
জাকির-সোহাগের কমিটির সময়ও বলেছিলাম ছাত্রলীগে নারী নেতৃত্ব সময়ের দাবি। বাংলাদেশের বয়সের চেয়ে বেশী বয়স বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। দীর্ঘ ৭০ বছরের ইতিহাসে একমাত্র “মারুফা আক্তার পপি” একবার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছিলেন। তিনি নেতৃত্বে, আন্দোলনের পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনতে হলে একটা ব্রেক থ্রো দরকার। বাংলাদেশের নারীরা, মমতায়, আবেগে যেমন মায়াময়, তেমনি প্রয়োজনে হতে পারে কঠোর। অন্তত দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, হওয়ার সম্ভাবনার ঝুঁকিটা কম থাকবে। আওয়ামী লীগ এখন আর আগের অবস্থানে নাই যে মারামারি ঝগড়াঝাঁটি করার জন্য যুদ্ধংদেহী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক লাগবে। নিরুপদ্রব টাইপের একটা কমিটি বরং দল এবং সরকারকে বিব্রত হওয়া থেকে অন্তত বাঁচাবে। নতুন কমিটির জন্য অগ্রিম শুভ কামনা রইল। জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, স্লোগানের সাথে ছাত্রলীগের হাত ধরেই পরিচয়। কৈশোর তারুণ্যের উদ্যম ভালোবাসা ছাত্রলীগ। তাই, প্রথম প্রেমের মায়া কাটে না।-জুয়েল রাজ, ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক