জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোমুখি অবস্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
শাহিনুর রহমান শাহিন-
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর ও শিক্ষকদের ওপর হামলার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ইস্যুতে ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার পর্যন্ত তৃতীয় দিন আমরণ অনশন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. আমির হোসেনের আশ্বাসে আমরণ অনশন প্রত্যাহার করেছে ৮ শিক্ষার্থী। এদিকে সোমবার উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য, শিক্ষক লাঞ্ছণা এবং উপাচার্য বাসভবনে ভাঙচুরের প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের শাস্তি’র দাবিতে ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল করেছে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা। ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’র ব্যানারে মৌন মিছিলটি অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে চার দফা দাবিতে মঙ্গলবার মহাসমাবেশ ডেকেছে ‘শিক্ষক- শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চ’।
জানা যায়, রোববার অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে না নেওয়ার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অনশন তুলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তবে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। রোববার বিকেল তিন ৩টা ৩০ মিনিটে ‘প্রতিবাদের নাম জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়। পাশাপাশি মামলা প্রত্যাহার এবং তদন্ত কমিটি বাতিলের দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘এই অনশনে বসার পরদিনই জরুরি সিন্ডিকেট সভা বসে। এ সভা কোনো নৈতিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। এছাড়া একই দাবিতে অন্যান্য কর্মসূচি চলতে থাকবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এর আগে শিক্ষার্থীদের অনশনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চ’।
ঐক্য মঞ্চের আহবায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন বলেন, ‘আমরা তাদের (অনশনরত শিক্ষার্থীদের) সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। তবে আমাদের (শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চের) ঘোষিত অন্যান্য আন্দোলন কর্মসূচি চলবে।’ এদিকে অনশনের কারণে রোববার রাতে অনশনরত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪০তম আবর্তনের পূজা বিশ্বাস, ইংরেজি বিভাগের ৪২তম আবর্তনের সর্দার জাহিদুল ইসলাম ও একই বিভাগের ৪২তম আবর্তনের তাহমিনা জাহান তুলি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদেরকে স্যালাইন দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসক তৌহিদ হাসান বলেন, গত দুইদিন যাবত না খেয়ে থাকায় তাদের শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে এবং রক্তচাপ কমে গেছে। শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বর্তমানে তাদেরকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে’। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও অনশনরত শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে।
এর আগে গত ১৫ জুলাই(শনিবার) বিকেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে আমরণ অনশন শুরু করে পূজা বিশ্বাস ও সর্দার জাহিদুর ইসলাম নামে দুই শিক্ষার্থী। পরে ১৬ জুলাই রোববার তাদের সঙ্গে যোগ দেন তাহমিনা জাহান ও খান মুনতাছির আরমান নামে আরো দুই শিক্ষার্থী ওই আমরণ অনশন কর্মসূচিতে যোগ দেয়। রোববার রাতে অনশনে যোগদান করেন দর্শন বিভাগের ৪৩ তম আবর্তনের ফয়সাল আহমেদ রুদ্র।
সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় অনশনকারী শিক্ষার্থীদের দেখতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কমিটির সদস্যরা। এসময় অনশন তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান তারা। তবে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের এই আহ্বান প্রত্যাখান করেছেন। পরে সন্ধ্যা ৭টা ৩০মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. আমির হোসেন শিক্ষার্থীদের পানি খাইয়ে অনশন ভাঙান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদসহ অন্যান্য শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। অনশন ভাঙার পর শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে প্রতিবাদী পথনাটক ‘একটি ননফিকশন’ প্রদর্শন করেন। এরপর সন্ধ্যা ৮টা ২০ মিনিটে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা না খেয়ে থাকবে তা আমাদের ভালো লাগেনি। একটা মনোবেদনা-মনোপীড়া আমাদের ছিল। এর মধ্যে শিক্ষক সমিতি এসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
অনশনরত এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে তারা অনশন প্রত্যাহার করেছে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলছি, এই পরিস্থিতিতে সম্মানজনক সমাধানের জন্য যা প্রয়োজন তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি, কোষাধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতিসহ অন্যান্য শিক্ষক সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।’ তার আগে সঞ্চালক সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সুস্মিতা মরিয়ম বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এবার এর ব্যতিক্রম দেখতে চাই।’ এর উত্তরে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এবারের অভিজ্ঞতা খারাপ হবে না। কারণ আপনারা আমাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন, আস্থা রেখেছেন। এটার মর্যাদা আমরা রক্ষা করবো, কোনো ত্রুটি থাকবে না।’
এ দিকে মঙ্গলবার বেলা ১১.৩০ টায় দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে মহা সমাবেশ করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সমাবেশ শেষে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে পুরাতন কলা ভবন প্রদক্ষিণ করে নতুন কলা ও মানবিকী ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। সমাবেশে বক্তারা ৭ দিনের মধ্যে মামলা তুলে নেয়ার দাবি জানান। এর মধ্যে মামলা তুলে না নিলে কঠোর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন।
এসএম