জিন্নাহ ‘স্বাধীনতার স্থপতি’, এ কোন প্রচারণা?
হঠাৎই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘এদেশের স্বাধীনতার স্থপতি’ বলে প্রতিষ্ঠা করার ধৃষ্টতা দেখানোটা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাও আবার কোন এক অখ্যাত বিদেশি লেখকের বয়ান থেকে আংশিক উদ্ধৃতি দিয়ে! পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ জিন্নাহ আর যাইহোক কখনই গান্ধী, নেহেরু, মৌলানা আজাদ বা সর্দার প্যাটেলের প্রভাবকে ডিঙিয়ে কখনোই ‘নিখিল ভারত’-এর নেতা হতে পারতেন না, তা একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই নিজের ব্যক্তিগত জীবনে হার্ডকোর নাস্তিক হওয়ার পরেও তিনি ব্যবহার করলেন উপমহাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে পুরনো ব্রহ্মাস্ত্র, যার নাম ধর্ম। ফলে জন্ম হয় ধর্মভিত্তিক অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের।
পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ছিল হাজার কিলোমিটারের ব্যবধান। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ছাড়া ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকর্ম, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদ কোনকিছুতেই কোন মিল ছিল না। এধরণের অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে আর কখনও কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে কারণে সর্দার প্যাটেল সে সময়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন ‘শুধুমাত্র ধর্মের উপরে ভিত্তি করে ইসলামিক স্টেট অফ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। এই পাকিস্তান ২৫ বছরও টিকবেনা।’ আসলেই টেকেনি।
জিন্নাহ পাকিস্তান বলতে যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানই বুঝতেন, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়, যখন তিনি ঢাকার জনসভায় দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা!” বাঙালিদের মায়ের মুখের ভাষার উপরে প্রথম আঘাত হেনেই তিনি বুঝিয়ে দেন তার প্রকৃত পরিচয় আর বাঙালিদের প্রতি নিদারুণ ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য। সভায় উপস্থিত ছাত্রজনতা যার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন সমস্বরে, “NO, NO, NO” বলে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগানে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা অনেকেই তখন সুর মেলান, ‘এই আজাদি ঝুটা হ্যাঁয়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যাঁয়’ স্লোগানে।
আর আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসে সেই জিন্নাহকেই দাবি করা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে! আর সেটা করা হলো ১৩ আগস্ট! যার দুদিন পরেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সেই নির্মম শোকাবহ ১৫ আগস্ট!
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তার জেলেই কাটে তাঁর। “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার” আহবান জানিয়ে মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকেরই। পশ্চিম পাকিস্তানীরা তো বটেই, সেই সাথে তাদের রেখে যাওয়া ঘাতক দালাল বাহিনী, তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রমহল, অনেকেই উল্লসিত হয়েছিলেন তাঁর সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডে। কারণ তাদের সাধের ‘প্যায়ারে পাকিস্তান’-এর মরণঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলো তাঁর বজ্রকন্ঠ। জন্ম হয়েছিলো স্বাধীন সার্বভৌম পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ।
জিন্নাহ যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে আরোহণ করেছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে, সেই একই পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাঁর খুনিরা। কারণ দেশের বেশীরভাগ মানুষই যে ধর্মভীরু। যে কারণে ১৫ আগস্ট নির্মম সে হত্যাকাণ্ড শেষে বাংলাদেশ বেতার দখল করে ঘোষণা দেয়া হয়,
“আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামিক স্টেট ও পাকিস্তান।”
তারা মনে করেছিল এভাবে ধর্মীয় ফ্লেভারযুক্ত প্রপাগণ্ডা চালিয়ে জায়েজ করে ফেলা যাবে এই মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞকে। বোকার দলের মাথায় এটাও আসেনি যে মাত্র ৪ বছর আগে যে মানুষটির ডাকে ‘ইসলামিক স্টেট অফ পাকিস্তান’ ভেঙে ‘পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ এর জন্ম দেয়া মানুষেরা এই নতুন করে ‘ইসলামিক স্টেট অফ বাংলাদেশ’ গড়ার মিষ্টি কথায় এতো সহজে ভুলানো যাবেনা। আর যায়ও নি। সময় হয়তো লেগে গেছে অনেক। কিন্তু বিচার না হয়ে যায়নি।
পাকিস্তান ভঙ্গের মর্মবেদনায় কাতর মানুষদের কাছে ‘জিন্নাহকে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা’ মার্কা ফেসবুক পোস্ট দিয়ে তাদের কয়েক হাজার লাইক কামানো হয়তো গেছে। কিন্তু তাতে কি ইতিহাসের সোপান বদলে যায় কখনও?
আর যারা ধর্মের কারণে পাকিস্তান ভঙ্গের মর্মবেদনায় আক্রান্ত হয়ে হাসিমুখে দেদারসে এসব লেখায় লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার করে যাচ্ছেন মহা আনন্দে, তারা যেদিন একটু পড়াশোনা করলেই জানতে পারবেন যে, এই জিন্নাহ সাহেব ছিলেন একজন ঘোরতর নাস্তিক, তার স্ত্রী ও ছিলেন নন মুসলিম, মদ্যপানে ছিল যার তীব্র আকর্ষণ, তখন তাদের ‘অনুভূতি’ কেমন হবে, সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করে।
অথচ আজ যার সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ড দিবসের মাত্র দুইদিন আগে যাকে হেয় করে জিন্নাহকেই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হলো সেই মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করে সেক্যুলার বাংলাদেশের জন্ম দেয়া, একই সাথে অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু ধর্মপ্রাণ বঙ্গবন্ধুই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দিনে দেশের মাটিতে পা রেখেই সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ অপেক্ষমাণ মানুষের সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন,
“আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলেম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।”
কাজেই জিন্নাহর মতো কোন বামন রাজনীতিবিদকে ‘স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে শোকাবহ ১৫ আগস্টের ঠিক আগেই বঙ্গবন্ধুকে এভাবে অপমানিত করার অপচেষ্টা না করলেই কি হতো না? লাইক না হয় কিছু কম কামালে কি এমন আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো?
এড়িয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করার পরেও এসব নোংরামি দেখলে আসলে সহ্য করতে খুব কষ্ট হয়। কবি বিপ্লব বড়ুয়ার মতোই তখন তীব্র ক্ষোভে আর দুঃখে বলে উঠতে ইচ্ছে করে,
সেই পল্টনে বলেছিলে তুমি, তোদের অস্ত্র জমা চাই,
পঁচাত্তরেই হেরে গেছি তাই, হে জাতির পিতা, ক্ষমা চাই।
- রাজেশ পাল: আইনজীবী, এক্টিভিস্ট।