টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা হচ্ছে পার্টি গার্ল
রাত নামলেই ভিন্নরূপ ধারণ করে ঢাকা। বদলে যায় ঢাকার বিভিন্ন তারকা হোটেল-রিসোর্টের দৃশ্যপট। বনানীর ওই বাসার মতো অভিজাত এলাকার অনেক বাসারও একই অবস্থা। নিয়নবাতি, লেজার লাইটের ঝলকানি। তরুণ-তরুণীদের হই-হুলোড়, উল্লাস। হিন্দি-ইংরেজি পপ গানের সঙ্গে নাচ। বিদেশি ব্রান্ডের মদের ঘ্রাণ। ইনডোরে এরকম দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে প্রতিরাতেই। গুলশান-২ এরকম একটি বাড়ির দুটি ফ্লোর ভাড়া নেয়া হয় শুধু রাতের পার্টির জন্য। বাসাটি একজন বিমানবালার। তার পরিবারের সদস্যরা থাকেন দেশের বাইরে। এক রাতেই অনেক টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হয় দুটি ফ্লোর। ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্রের প্রযোজক, সরকারি আমলারা আয়োজন করেন এসব পার্টির। শুধু এই দুটি বাসা নয়, এরকম পার্টি হয় রাজধানীর শত-শত বাসায়।
তরুণ-তরুণীদের নিত্যদিনের পার্টি হয় সিসা বারে। ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীতে রয়েছে বিভিন্ন লাউঞ্জ। এতে জন্মদিন ও ‘রিলেশনশিপ ডে’ পালন করেন তরুণ-তরুণীরা। কেক কাটা ছাড়াও এসব পার্টিতে থাকে সিসা সেবনের ব্যবস্থা। সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই জমে উঠে সিসাবারগুলো। সিসা লাউঞ্জের ভেতরে পা রাখলেই মিষ্টি ঘ্রাণে মুগ্ধ হন আগতরা। ভেতরের আবছা আলো-অন্ধকারে আপন ভুবনে হারিয়ে যান তরুণ-তরুণীরা। লাল-নীল রঙের ডিমলাইট। ধোঁয়াচ্ছন্ন চারপাশ। মিউজিক প্লেয়ারে বাজে ইংরেজি গান। পরিপাটি টেবিল ঘিরে সোফায় বসে সিসার হুঁক্কা টানতে টানতে জমে আড্ডা। একজনের পর আরেকজন। এটাই সিসা বারের দৃশ্য। এই সিসা পার্টি চলে সাধারণত সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত।
সিসা বারের বর্ণনা দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শামসুল আলম বলেন, সিসা বারগুলোতে রয়েছে আপত্তিকর পরিবেশ। স্বল্পবসনা তরুণীদের উপস্থিতি। সেখানে তরুণ-তরুণীরা কোল বালিশে শুয়ে-বসে সিসা টানতে থাকে। সৃষ্টি হয় আপত্তিকর দৃশ্যের। তবে এই সিসায় মাদকের ব্যবহারের তথ্য পেলেই অভিযান করা হয় বলে জানান তিনি।
সিসা বারের মিনিপার্টি ছাড়া বড় আকারে নানা পার্টি হচ্ছে ঢাকায়। পার্টি মানেই মদ, নারী, ডিজে। সূত্রমতে, গত কয়েক বছর ধরে কমার্শিয়াল পার্টি কমেছে। কিন্তু বেড়েছে ঢাকার বাইরে। তবে ঢাকায় বেড়েছে কর্পোরেট পার্টি। বিভিন্ন কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান প্রায়ই আয়োজন করছে এরকম পার্টির। পার্টি হচ্ছে বিভিন্ন ক্লাবেও। এসব পার্টির মূল আকর্ষণই হচ্ছে মদ, নারী ও ডিজে। কোথাও কোথাও ডিজে না হলেও মদ থাকছেই। মদ পানকে ঘিরে হচ্ছে পার্টি। এসব পার্টিতে অভিজাত শ্রেণির প্রাপ্ত বয়স্করাই বেশি অংশ নেন। পার্টিতে নির্দিষ্ট নারীদের অংশগ্রহণ থাকে। কোনো কোনো বাসায় পার্টিতে মদ পান করতে করতে নাচে মেতে উঠেন নারী-পুরুষ। গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায় প্রতি রাতেই হচ্ছে এরকম পার্টি।
ঢাকার অনেক অভিজাত পরিবারে জন্মদিন, বিয়ে ও গায়ে হলুদ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় ডিজে পার্টির। এ বিষয়ে ডিজে মারিয়া বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। একটা সময় ডিজে পার্টির কোনো কদর ছিল না। মানুষ নানা নেতিবাচক মন্তব্য করতো। এখন তো ডিজে পার্টি ছাড়া খুব কমই জন্মদিন, বিয়ে, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়। এমনকি নতুন বাসা-বাড়ি উদ্বোধন করতে গিয়েও ডিজে পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে। দিনে-দিনে এসব পার্টির কদর বাড়ছে বলে জানান এই ডিজে।
এসব পার্টিতে আনন্দ যোগাতে অংশ নেন সুন্দরীরা। তারা ‘পার্টি গার্ল’ হিসেবেই পরিচিত। সহস্রাধিক পার্টিগার্ল রয়েছেন ঢাকায়। তারা সাধারণত বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বাড়তি টাকা উপার্জন ও আনন্দ উপভোগ করার জন্যই তারা টাকার বিনিময়ে পার্টিতে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পার্টিগার্ল জানান, প্রতি রাতে পার্টিতে অংশগ্রহণের জন্য আয়োজকদের কাছ থেকে তিনি নেন তিন হাজার টাকা। শর্ত হিসেবে ওয়েস্টার্ন পোশাক পরে, সেজেগুঁজে পার্টিতে অংশ নেন। পার্টিতে আনন্দ দিতে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের সঙ্গে নাচ করেন এই তরুণী। পানীয় পান করতে হয়। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে সবকিছু করেন বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে ডিজে পরী বলেন, ডিজে হিসেবে আমরা গানের সঙ্গে বাজাই। আর পার্টির প্রয়োজনেই পার্টিগার্লরা দর্শকদের বিনোদন দিতে বিভিন্ন কাজ করেন। কেউ নাচ করেন। কেউ রিসিভশনে দায়িত্ব পালন করেন। পার্টিতে অংশগ্রহণকারী কেউ মাতাল হয়ে গেলে তাকে সামলাতে হয় তাদের। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পার্টিগার্লদের প্রতিরাতে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। কেউ কেউ বাড়তি সেবা দিয়ে পার্টিতে অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে আরো টাকা আয় করতে পারেন বলে জানান তিনি। সূত্রমতে, যেসব সুন্দরী ভালো নাচ করতে পারেন পার্টিতে তাদের বেশি কদর। সানজিদা নামে এক পার্টিগার্ল জানান, কমার্শিয়াল পার্টিগুলোতে অংশ নিলে তার উপার্জন ভালো হয়। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অংশ নেন। তাদের বেশিরভাগই সঙ্গী ছাড়া পার্টিতে অংশ নেন। মূলত পার্টিগার্লদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যেই অংশ নেন তারা। তাদের কাছ থেকে নগদ টাকাসহ নানা উপহার পান।
কমার্শিয়াল পার্টি বেশি হচ্ছে ঢাকার বাইরে। গাজীপুর, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। গুলশান, বনানী ও উত্তরার বিভিন্ন বাসায় পার্টি হলে তাতেও অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এই তরুণী। সকল পেশাই সম্মানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা আমার পেশা। এতে আমি ও আমার পরিবার নির্ভরশীল। তাই যেখানে বেশি টাকা আয় হয় সেসব পার্টিতে অংশ নিতে আমার আগ্রহ বেশি। মিরপুর এলাকার এক তরুণ ব্যবসায়ী জানান, মাঝে-মধ্যে উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে এক বন্ধুর বাসায় পার্টি করেন তারা। সেখানে রাতের খাবারের আয়োজন থাকে। মদের ব্যবস্থাও থাকে। কারণ হিসেবে জানান, পার্টিতে দেশের বাইরের বন্ধুরাও অংশ নেন। তবে তাদের পার্টিতে নারী থাকে না বলে দাবি করেন এই তরুণ।
বাসা, হোটেল ছাড়া আড্ডা হয় বিভিন্ন স্থানে। এক মডেল জানান, কাজের প্রয়োজনে রাতে বের হন তিনি। মিউজিক ভিডিও’র শুটিংসহ নানা কাজ থাকে তার। কাজ শেষে খাওয়া-দাওয়া করেনই গাড়ি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বের হন। রাতের যানজটহীন, নিরব ঢাকায় বেড়াতে ভালো লাগে তার। মাঝে-মধ্যে বন্ধুরা মধ্য রাতে হাতিরঝিলের ব্রিজে আড্ডা দেন। গান করেন। এভাবেই রাতের পার্টি হয় তাদের। ওয়েস্টিন, রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেল, রিজেন্সি, সেরেনা, লা মেরিডিয়ানে আয়োজন করা নানা রকম পার্টির। রুম ভাড়া নিয়ে নিজ উদ্যোগে ছোট-খাটো পার্টি করেন অনেকে। ডিজে পরী বলেন, প্রতি রাতেই নানা পার্টি হচ্ছে। তবে প্রতি মাসে ঢাকায় ডিজে পার্টি হয় অন্তত ১০ থেকে ১৫টি। অধিকাংশ পার্টিতে তিনি অংশ নেন। তবে কমার্শিয়াল পার্টি বেশি হয় ঢাকার বাইরে। এছাড়া প্রতি রাতেই নানা পরিবেশে নানা ধরনের শত-শত পার্টি হচ্ছে এই ঢাকায়।