তোপের মুখে মুন্নী সাহা
টকশোর শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নাম ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করে সামাজিক মাধ্যমে তোপের মুখে পড়েছেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহা। সোমবার রাতে ‘নিউজ আওয়ার এক্সট্রা’ টকশোর শিরোনাম নাম ছিল ‘আ আ. ম. স. VC!’। এতে ভিসি আরেফিন সিদ্দিকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, নতুন ভিসি প্যানেল গঠন বিতর্ক নিয়ে আলোচনা হয়। টকশো-তে আগত অতিথিদের সঙ্গে উপস্থাপক হয়ে নিজেই বাকবিতণ্ডায় জড়ানো এবং টকশো’র এমন বিতর্কিত সব শিরোনাম করায় মুন্নী সাহার সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই পেশায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞরা।
মুন্নী সাহার উপস্থাপনায় এ টকশোতে অতিথি হিসেবে ছিলেন, শিক্ষাবিদ ড. অজয় রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রহমতউল্লাহ এবং দৈনিক শিক্ষা ডটকমের সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান। টকশোর শিরোনাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভিসি আরেফিন সিদ্দিকপন্থী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এনিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকজন শিক্ষক এবং ভিসি আরেফিন সিদ্দিকের ভক্ত সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মুন্নী সাহা শুরুতেই অবশ্য অনুষ্ঠানের নামকরণের বিশ্লেষণও করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই হয়ত জানেন আবার অনেকে হয়ত জানেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য আছেন তার নাম আ. আ. ম. স. আরেফিন সিদ্দিক। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, আজীবন আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য।’ অনুষ্ঠানটি প্রচার হওয়ার পরপরই টকশোর বিদ্রুপাত্মক এই নাম নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কীভাবে একজন সিনিয়র সাংবাদিক দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে এমন শিরোনাম দেন? একজন শিক্ষককে নিয়ে এ ধরনের বিদ্রুপ কোনোভাবেই মানা যায় না বলে মন্তব্য করছেন সাংবাদিকতার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে সিনিয়র সাংবাদিক, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুন্নী সাহা প্রায়ই সাংবাদিকতার নৈতিকতা লঙ্ঘন করেছেন। সাংবাদিকতার বিভিন্ন সেকশনে তিনি প্রায়ই বিতর্কিত কাজ করছেন। তিনি এই পেশায় জড়িত অন্যদেরকেও বিতর্কে ফেলছেন। সাংবাদিকতাকে কলুষিত করছেন বলেও মনে করছেন তারা।
নিজের ফেসবুক ওয়ালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আখতার খান লিখেছেন, ‘আ আ ম স VC!’ এ কোন ধরনের শিরোনাম? তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জানা থাকা উচিৎ সমালোচনা করা যায় কিন্তু বেয়াদবি নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাকিব আহমেদ লিখেছেন, ‘Munni Saha is an absolute rubbish.’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক আসাদুজ্জামান কাজল নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘মুন্নি সাহা মিথ্যা বলেছেন। তিনি ভিসি স্যারকে শুধু বলেছেন, তিনি স্যারকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করতে চান। এর বাইরে কোন কথা স্যারের সাথে তার হয়নি…টাইটেলের অনুমতি তিনি নেননি। ধিক্কার… ধিক্কার… ধিক্কার…।’
চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর-এর সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার ফারাবি হাফিজ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আরেফিন স্যার এবং মুন্নিদি দুই জনই আমার সরাসরি শিক্ষক। একজন থিওরি পড়িয়েছেন আরেকজন বাস্তব চিনিয়েছেন। দু’জনেরই আমি আদরের। কিন্তু এভাবে একজন উপাচার্যকে নিয়ে নিয়ে ব্যাঙ্গ করার অধিকার আপনাকে দেয়া হয়নি দিদি। এটা কোন সংজ্ঞায়ই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না বলে আপনার থেকে শেখা আমার ক্ষুদ্র সাংবাদিকতার জ্ঞান বলে। আর এ ও মনে হয় যে, আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর আমাকে মাফ করবেন দিদি এভাবে পাবলিক পোস্ট দিতে হলো। আর যদি পিসিআরের লোকজন এটা করে থাকে আপনার এ্যাকশন নেয়া উচিত।’
বিবার্তা২৪.নেট-এর সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি লিখেছেন, ‘ছি, মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকে। ঔদ্ধত্যেরও একটা পরিসীমা থাকা উচিত। তিনি (মুন্নী সাহা) ভিসি স্যারকে শুধু বলেছেন, তিনি স্যারকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করতে চান। এর বাইরে কোনো কথা স্যারের সাথে তার হয়নি। শিরোনামের অনুমতি তিনি নেননি। ধিক্কার…’
দৈনিক প্রথম আলো’র স্টাফ রিপোর্টার সাদ্দাম হোসাইন লিখেছেন, মুন্নী সাহার মিথ্যাচার। মুন্নী সাহা মাঝে মধ্যেই বেক্কলের মতো প্রশ্ন করেন– এমন কথা লোকে বলে। কিন্তু তার আজকের কর্মকাণ্ডে আক্কেলজ্ঞান হীনতার পাশাপাশি নীচু মানুষিকতারও প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, টকশো চলার সময় তিনি এই নীচু মানুষিকতাকে জায়েজ করতে বললেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক স্যারের কাছে তিনি অনুমতি নিয়েছেন; খটকা লাগায় স্যাররে কাছে জানতে চেয়েছিলাম। স্যার জানিয়েছেন মুন্নী সাহা শুধু অনুষ্ঠান করার কথা জানিয়ছেন, ওমন শিরোনামের ব্যাপারে কোনো কথাই হয়নি। এভাবে একজন সম্মানিত মানুষকে অসম্মান করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে মুন্নী সাহা? আপনার উচিৎ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, বেয়াদবির একটা সীমা থাকা উচিৎ।’
‘দেশের রাজনীতিতে তিনটি স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট এবং প্রেসক্লাব’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই তিনটি স্থানকে অস্থিতিশীল কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যেকোনো সরকারের ভীত নড়িয়ে দেওয়া যায়। বিএনপি জামাত গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা প্রেসক্লাব নিয়ে অনেকদিন অপচেষ্টা করলেও এখন হতাশ। কোর্ট প্রাঙ্গণে তাদের অবস্থান এখনও সুদৃঢ়। মাঝে মধ্যেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।’
তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সাড়ে ৮ বছরে তারা কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি। উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার বঙ্গবন্ধু কন্যার সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুন্দর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন। বিএনপি জামাত নিজেরা ঢুকতে না পেরে এখন ব্যবহার করছেন তাদের দোসর তথাকথিত সুশীলদের। এই সুশীলরা খুব সুক্ষভাবে প্রগতিশীল শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ওনাদেরকে ব্যবহার করছেন আরেফিন স্যার এর বিরুদ্ধে।’
‘এই সুযোগে সুশীলরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। ওনারা হয়তো স্বপ্ন দেখছেন আরেফিন সিদ্দিককে সরাতে পারলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ক্যাম্পাস দিয়ে একটি নাড়া দেয়া যাবে’, উল্লেখ করেন তিনি।
আশরাফুল ইসলাম খোকন লিখেছেন, ‘আপনাদের ভুলে যাওয়ার কথা না, সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এই ক্যাম্পাসেই ২/৩ টি লাশ ফেলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিলেন। টেলিফোনে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে বলেছিলেন, ক্যাম্পাসে কয়েকটি লাশ ফেলতে পারলেই বাকি কাজটুকু ওনারা করবেন। এই লাশ ফেলার জন্যই হয়তো আরেফিন স্যারকে সরানো ওনাদের জন্য জরুরি।’
এটা কোন ধরনের ভদ্রতা? প্রশ্ন রেখে তিনি লিখেন, ‘যথাসময়ে যথানিয়মে যিনি উপাচার্য হবার তিনিই হবেন, এটা যে কেউ হতে পারেন। তাই বলে একজন ভদ্রলোকের চরিত্রহনন? এটা কোন ধরনের সভ্য আচরণ। ভুলে গেলে হবে না, আরেফিন সিদ্দিক স্যাররা ক্ষণজন্মা। যুগে যুগেও জন্মায় না। আজ পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধে তার চরম শত্রুরাও কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ আনতে পারেননি।’এদিকে ‘অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে’ বুধবার দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। এসব বিষয় নিয়ে মুন্নী সাহার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।