বার্তা ডেক্সঃঃগত বৃহস্পতিবার সকালে হঠাৎ একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী আসমা আক্তারের (৩২) ছোট ভাইয়ের মোবাইলে। কল রিসিভ করার পরই মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে একজন বললেন, আপনার বোন আসমা সৌদিআরবে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বোনের মারা যাওয়ার খবর শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ভাইয়ের। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এই খবর জানানোর পরই স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে বাড়ির পরিবেশ। এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে তাদের বাড়িতে। এই খবর পাওয়ার পর থেকেই আসমার লাশের অপেক্ষায় আছেন তার স্বজনরা।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বনগাঁও গোছাপাড়া গ্রামের আসমা আক্তার (৩২)। ৭ বছরের ছেলেকে রেখে ভাগ্য বদলের আশায় ২০১৮ সালের শেষের দিকে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবে পাড়ি জমান আসমা। তিনি সৌদি দূতাবাসের এক কূটনীতিকের বাসায় কাজ করতেন। সৌদির যে পরিবারে আসমা কাছে কাজ করতেন, তারা তাকে জর্ডানে নিয়ে যান। সম্প্রতি জর্ডানের আম্মানে ময়লার ডাস্টবিনে আসমার মরদেহ দেখে পুলিশে খবর দেন স্থানীয়রা। এরপরই আসমার মারা যাওয়ার খবর তার পরিবার, বাংলাদেশ দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আসে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ দূতাবাস তদন্ত করছে বলে জানা যায়। আসমা আক্তারের ছোট ভাই বলেন, গত বৃহস্পতিবার একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দিয়ে বলা হয় আমার বোন জর্ডানে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা সঠিক জানি না কিভাবে মারা গেছে। যে কল দিয়ে বলছে তারেও চিনি না। আমার এক মামা সৌদি আরবে থাকেন। তার সাথে কথা বলেছি, তিনি লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেবেন।
আসমার মত প্রবাস থেকে লাশ হয়ে দেশে ফেরা নারীদের তালিকা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৪৭৩ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে। যার মধ্যে ৫১ জনই আত্মহত্যা করেছেন। আর অন্যান্য দেশ আত্মহত্যার সংখ্যা অন্তত ৮১ জন। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মধ্যে বিদেশ থেকে অন্তত ৬৩ জন নারীর মরদেহ দেশে ফেরত এসেছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেই এসেছে ২২ জনের মরদেহ। এ ছাড়া, লেবানন থেকে ১৪, জর্ডান থেকে ১১, ওমান থেকে সাত, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে চার জনের মরদেহ এসেছে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সিলেট বিভাগের ৬জন নারী গৃহকর্মীর লাশ এসেছে। যার মধ্যে মৌলভীবাজারের ৩ জন, সুনামগঞ্জের ২ জন ও হবিগঞ্জের ১ জন রয়েছেন।
প্রবাসে নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ বলা হচ্ছে আত্মহত্যা, স্ট্রোক এবং দুর্ঘটনা। যদিও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবী করেন গৃহকর্তা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর টিভি। সেখানে এ ব্যাপারে জর্ডানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান বলেন, আমরা যেটা আনঅফিসিয়ালই পেয়েছি, বাংলাদেশি একটা মেয়ের লাশ ডাস্টবিনে পড়ে ছিল। সকালবেলায় যখন ওরা ক্লিন করে ডাস্টবিন তখন দেখতে পায়। ময়লা যখন ফেলেছে ওর মধ্যে মেয়েটার লাশ পড়ে ছিল। এদিকে জর্ডানের ডাস্টবিনে আসমার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জনশক্তি সংশ্লিষ্টরা। বিদেশি নারীকর্মী নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত না হবার কারণেই এমন ঘটনা দিন দিন বাড়ছে বলেই মন্তব্য করছেন তারা।
আসমার ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন শনিবার (২১ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগ জানায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহানা সাঈদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এক সংবাদে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান জানিয়েছেন ডাস্টবিনে যে মেয়েটির মরদেহ পাওয়া গেছে তিনি একজন গৃহকর্মী ছিলেন। এই নারী শ্রমিকের চুক্তি ছিল সৌদি আরবে কাজ করার। তিনি যে সৌদি পরিবারে কাছে কাজ করতেন, তারা তাকে জর্ডানে নিয়ে এসেছে। স্থানীয় পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে এবং পুলিশের কাছে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। তিনি বলেন, একজন প্রবাসী গৃহকর্মীর এই ধরনের মৃত্যু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভিকটিমের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেওয়া হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছেও এই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হবে।
এ ব্যাপারে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, প্রবাসে নারী গৃহকর্মী মারা যাওয়ার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের নারী গৃহকর্মীদের সৌদিআরব থেকে বিভিন্ন দেশে নিয়োগকর্তারা নিয়ে যাচ্ছেন এবং তারা মারা যাচ্ছেন। তারা কেন মারা যাচ্ছেন, কি করে অন্য দেশে গেলেন, কার সাথে গেলেন এই ঘটনাগুলো তদন্ত করা দরকার। কারণ এসব ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব শ্রমশক্তি রপ্তানির উপর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার এখন সৌদি আরব। এই সৌদি আরবেই বেশিরভাগ নারী শ্রমিক মারা যাচ্ছেন। ২০১৫ সাল থেকে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ নারী কর্মী যাওয়া শুরু করে। ২০১৬ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭৩ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ৬৩ জন মারা গেছে চলতি বছর। গতবছর পর্যন্ত মৃত ৪১০ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি মারা গেছে সৌদি আরবে, ১৫৩ জন। এই বছরের ২২ জন ধরলে এই সংখ্যা ১৭৫ জন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৩৪ বার