দুই শিক্ষার্থীকে পিষে মারলো বেপরোয়া বাস
প্রত্যক্ষদর্শী একরামুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমি ঘটনাস্থল দিয়ে মোটরসাইকেল করে যাচ্ছিলাম। বাসটি যখন শিক্ষার্থীদের আঘাত করে তখন আমি মোটরসাইকেল সাইড করে নেমে পড়ি। বাসের কাছে গিয়ে দেখি দুটি মরদেহ পড়ে আছে। আমরা কয়েকজন মিলে বাসটিকে পেছনের দিকে ঠেলে দিই। তারপর দেখতে পাই বাসের নিচে পড়ে থাকা শিক্ষার্থীরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। তখন আমি নিজে বাসের নিচ থেকে ২ জন মেয়ে শিক্ষার্থী ও ৩ জন ছেলে শিক্ষার্থীকে টেনে বের করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। একরামুল বলেন, বাসের নিচ থেকে ৫ জন ও বাসের সাইড থেকে আরো ৫-৬ জনকে আমি উদ্ধার করেছি। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, আমরা কলেজেই ছিলাম। খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি ও আমার বন্ধুরা ঘটনাস্থলে আসি। তারপর আর আমাদের মাথা ঠিক ছিল না। চেনা মানুষগুলোর মরদেহ পড়ে আছে। বাকিরা চিৎকার করে কাঁদছে। এ দৃশ্য সহ্য করার মতো ছিল না। আবদুল্লাহ বলেন, আর কত প্রাণ ঝরবে। বেপরোয়া এসব বাসের রেষারেষিতে। আমরা এর বিচার চাই। আমরা আমাদের আর কোনো বন্ধুকে এভাবে অকালে চলে যেতে দেবো না। জাহিদ ইসলাম নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান, এদের দায়ভার কে নেবে। আর কত মৃত্যু হলে বাসের চালকরা থামবে। আমরা আমাদের আর কত আপনজন হারাবো।
মেয়েকে হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন দিয়া খানম মিমের বাবা। পরিবারের সঙ্গে মহাখালি এলাকায় মিম থাকতো। ২ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে মীম সবার ছোট। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে পড়তো। তার বাবা ঢাকা চাঁপাই নবাবগঞ্জ-রাজশাহী রুটের তিতাস বাসের চালক। এছাড়া তিনি এক সময় মহাখালি বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। মিমের বাবা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, কিছুদিন ধরে আমার মেয়ের স্কুল ৮টা থেকে শুরু হয়। তাই বাসা থেকে ৭টার দিকে রওয়ানা হয়। প্রতিদিনই আমি তাকে বাসে তুলে দেই। আজ (গতকাল) সকালেও সে আমাকে বলেছে তার মা বাসে তুলে দিবে। তাই সকালবেলা আলম এশিয়া নামের একটি বাসে উঠে সে এমইএস নামে। সেখান থেকে কলেজে যায়। ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেউ একজন আমাকে ফোন দিয়ে বলে কুর্মিটোলা হাসপাতালে আসার জন্য। এসে দেখি আমার মেয়ের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পড়ে আছে। জাহাঙ্গীর বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে গাড়ি চালাই। কখনই আমার হাতে কেউ মরেনি। এমনকি হাত-পা ভাঙার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিছু লোভী মালিক কম টাকায় অদক্ষ চালক দিয়ে বাস চালানোর কারণে আজ আমার মেয়েকে হারালাম। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। নিহত আবদুল করিম রাজিবের বোন কুলসুম বলেন, তারা সবাই গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় খালাতো ভাইয়ের বাসায় থেকে রাজিব লেখাপড়া করতো। তাদের বাবা মৃত নুরুল ইসলাম মারা গেছেন অনেক আগে। রাজিবকে নিয়েই পরিবারের সব স্বপ্ন ছিল। সে একদিন চাকরি করবে। সংসারের দায়িত্ব নিবে। কুলসুম বলেন, আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমার মা রাজিবের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ।
সহপাঠীদের মধ্যে শোকের ছায়া: এদিকে সহপাঠীদের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে। খবর পেয়ে ঘটনার পরপরই সবাই ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। সেখানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-ভাঙচুর করেন। পরে তারা সবাই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ভিড় করতে থাকেন শত শত শিক্ষার্থী। এ সময় শিক্ষার্থীদের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছিল। চিৎকার করে নিহত বন্ধুর নাম ধরে ডেকে অনেকে কাঁদছিলেন। অতীতের অনেক স্মৃতির কথা মনে করেও অনেক শিক্ষার্থীরা কান্না করছিল। সহপাঠীদের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে আসে। তাদের সান্ত্বনা দিতে আসেন তাদের পরিবারের সদস্যরাও। আবদুল্লাহ আল আমিন নামের এক সহপাঠী বলেন, বেপরোয়া বাসের চালকদের জন্যই আমাদের বন্ধুদের হারিয়েছি। আমি এই চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, ভাঙচুর করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। জাবালে নুর বাসের চালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।