দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনছেন হাওরবাসী
আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ।।
হাওরে থামছে না কৃষকের কান্না। একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে তাদের এখন ঘোর দুর্দিন। প্রকট দারিদ্রকে সঙ্গী করে চলছে হাওর পারের মানুষের জীবন।চরম এই দুঃসময় ভাবিয়ে তুলেছে এক সময়ের এই সমৃদ্ধ জনপদের বাসিন্দাদের।এমন অবস্থাকে অনেকেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আলামত হিসেবে দেখছেন।কোনোরকমে বেঁচে থাকতে অনেকেই প্রিয় গৃহকোণ ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জীবিকার তাগিদে বদলে যাচ্ছে হাওপাড়ের জীবনধারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাওরের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কিন্তু সারা বছর কৃষি কাজ থাকে না। একমাত্র বোরো ফসল ছাড়া হাওরে আর কোনো ফসল হয় না। বছরের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বোরো চাষাবাদ শুরু হয়। সে ফসল ঘরে ওঠে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। এরপর বেকার হয়ে পড়েন লাখো কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত বর্ষার ছয় মাস সেখানে কোনো কাজ থাকে না। কর্মহীন এই সময়টাতে হাওরের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তীব্র আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। কৃষিনির্ভর হাওর এলাকায় কৃষিভিত্তিক কোনো শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি। হাওরের কৃষি নির্ভর ৮০/৮৫ ভাগ মানুষের বাইরে বাকি ১৫/২০ ভাগের পেশা ব্যবসা, চাকুরি ও মাছ ধরা। কিন্তু প্রভাবশালী মহল ও অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাপটে প্রকৃত জেলেরা হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে পারে না। ফলে এমনিতেই হাওরবাসীকে সংকটে-সংগ্রামে বছর পার করতে হয়। এছাড়া যে বছর আগাম বন্যায় ফসলহানি হয়, সেবছর তাদের আর দুর্দশার শেষ থাকে না। এবারের নজিরবিহীন আগাম বন্যা মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে কৃষকের। একমাত্র কষ্টের ফসলটি তলিয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন কৃষক। এ পরিস্থিতিতে হাওরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে। নতুন ধান তোলার উৎসবের বদলে হাওর এখন চরম বিষাদময়। মহাজনী, এনজিও আর ব্যাংক ঋণের ভারে তারা জর্জরিত। জীবন-জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় সময় কাটছে হাওরবাসীর।
ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের কাঠুইর গ্রামের সামর্থ্যবান কৃষক রামপদ সরকার। এবার তিনি ১০০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। হাপানিয়া ও মূলদাইরের হাওরের এসব জমিতে ফলনও হয়েছিল ভালো। কিন্তু চৈত্রের বন্যায় দু’টো হাওরই এখন পানির নিচে। ধান পাকার আগেই জমি তলিয়ে যাওয়ায় গোলায় ধান ওঠানো দূরের কথা, কোন জমিতে কাঁচি-ই দিতে পারেননি তিনি। অথৈ পানিতে ভাসমান বিস্তীর্ণ হাওরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রামপদ সরকার। বলেন, এই একটিমাত্র ফসলই আমাদের সম্বল। সেই ফসল এখন পানির নিচে পঁচছে। এ-ও কি সওয়া যায়! ধনপুরেরই ঘোষপাড়ার কৃষক বিমল ঘোষ এবার ২০ একর জমি করেছিলেন। হাপানিয়ার হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তিনি এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। বিমল ঘোষ জানান, তার এলাকার শত শত কৃষকের অবস্থা একই। কান্না ছাড়া এখন তাদের আর কোনো উপায় নেই। ধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হরনাথ দাস জানালেন, ধনপুর ইউনিয়নের সবচেয়ে উঁচু হাওর হলো আনবোলাই হাওর। চান্দিনা বিলের পানির তোড়ে রামপুরের কাছে রাস্তা ডুবে এই হাওরটিও তলিয়ে গেছে। পুরো ইউনিয়নে এখন বলতে গেলে কোনো হাওরই আর অবশিষ্ট নেই। প্রায় চার হাজার হেক্টর জমির ফসল সবই এখন পানির নিচে। এক একর ধান কাটতে পারা কোনো কৃষক এই ইউনিয়নে পাওয়া যাবে না বলেও জানান ইউপি চেয়ারম্যান। ধনপুর ইউনিয়নের মতোই শোচনীয় অবস্থা জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের কৃষকের। এই ইউনিয়নের হাওরগুলোতে চার হাজার হেক্টর বোরো আবাদ করেছিলেন কৃষক। কিন্ত আগাম বন্যার শুরুতেই এলাকার সবচেয়ে বড় বিজয় বাঁধ হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ফসল হারিয়ে কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এরপরও মুদিরগাঁও উত্তরের বন্দ ও জয়সিদ্ধি উত্তরের বন্দ নিয়ে মুদিরগাঁও, পাগলশী, আলগাপাড়া ও ডুইয়ারপাড়সহ কয়েক গ্রামের কৃষক আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এসব হাওরও এখন পানিতে থৈ থৈ করছে। আলগাপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল আউয়াল জানান, আগুনখালির হাওরে ৬ একর জমি করেছিলেন তিনি। এই হাওরের অন্য কৃষকদের মতো তার জমিও চলে গেছে পানির নিচে। করণশী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, বিজয় বাঁধ হাওরে তার ১৯ একর জমি ছিল। বৃদ্ধা মা-কে সান্তনা দিতে তলিয়ে যাওয়া হাওর থেকে শ্রমিক দিয়ে দুই একরের মতো জমি কেটেছিলেন। কেটে আনা এসব কাঁচা ধানের আঁটি গরু-মহিষও খায়নি। ধনপুর ও জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের মতো সর্বস্ব হারিয়েছেন মৃগা ইউনিয়নের কৃষকও। মৃগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কামরুল হাসান জানান, মৃগা ইউনিয়নের ১০টি হাওরের সবকটিই তলিয়ে গেছে। এতে অন্তত ৬ হাজার হেক্টর জমির কাঁচাপাকা ধান পানির নিচে পড়েছে। ফসল হারিয়ে ইউনিয়নের মৃগা, লাইমপাশা, ভাটি রাজিবপুর, উজান রাজিবপুর, রামকৃষ্ণপুর, পাটাবুকা, জগন্নাথপুর, কালীপুর, কাটিয়ারকান্দা, শ্রীরামপুর, বড়বাড়ি চানপুর, ঝুরকান্দি, শান্তিপুর, গজারিয়াকান্দা, আন্ধাইর ও প্রজারকান্দা গ্রামের কৃষক এখন অকুলপাথারে। তিনি জানান, চৈত্র মাসে এমন আগাম বন্যার ঘটনা নজিরবিহীন। অনেক জমিতে ধানে ভালো করে দুধও আসেনি। এসব জমি কেটে গরু-মহিষকেও খাওয়ানো যাবে না। কৃষকেরা জানান, অন্যান্য বছরে বৈশাখের শুরুতে আগাম বন্যা হানা দেয়। তখন হাওর প্লাবিত হলেও কৃষক ডুবে যাওয়া জমি যতটুকু সম্ভব কেটে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারের আগাম বন্যায় জমি থেকে সে রকম করে কিছু ফসল তোলারও সুযোগ নেই। ইটনা সদর ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, উপজেলার সবচেয়ে উঁচু হাওর উপজেলা সদরের দক্ষিণের মাইজের বন্দ হাওর। এই হাওরটি ছাড়া সদর ইউনিয়নের বাকি সব হাওরই তলিয়ে গেছে। হালালের হাওর, ঝিয়লের হাওর, ফনিয়ারজান, বনপুর ও আলালের বাঁধ এলাকার ধানী জমিতে এখন থৈ থৈ করছে পানি। ইউনিয়নের অন্তত সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমি আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ইটনা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোহাগ মিয়া। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইটনা উপজেলায় আবাদী জমির অন্তত ৭৫ ভাগ তলিয়ে গেছে। এখানে মোট আবাদী জমির পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৬৬৫হেক্টর। সে হিসেবে কেবল ইটনা উপজেলাতেই ২০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইটনা উপজেলার মতোই বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে পার্শ্ববর্তি মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার কৃষক। এই দুই উপজেলার ৪০ হাজার ৫১২ হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার জমির ফসলহানি হয়েছে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন। সে হিসেবে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম এই তিন উপজেলায় ফসলহানির শিকার হয়েছে অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমি। এসব জমি থেকে উৎপাদিত হতো পৌনে দুই লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি চাল, যার প্রাথমিক মূল্য ছয়শ’ কোটি টাকারও বেশি। মিঠামইনের চারিগ্রামের কৃষক মিলন চৌধুরী জানান, বানের পানিতে তার ২৫ একর জমি তলিয়ে গেছে। কোলাহানি গ্রামের ছাত্তার মিয়া ও আবুল হোসেনসহ কয়েকজন কৃষক জানান, এবার শুধু মানুষের খাদ্য ঘাটতিই যে হবে তা নয়, যাদের বাড়িতে গরু আছে তারা গরুর খাবার নিয়েও বিপদে পড়েছেন। এজন্য জলের দামে অনেকে আগেভাগে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম মঙ্গলবার ইটনা ও মিঠামইনের ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি দুপুরে মিঠামইনের আতপাশা এলাকার এমএ গণি ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তৃতা করেন। সমাবেশে স্থানীয় (কিশোরগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য ও প্রেসিডেন্টপুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান। তার এই দাবির জবাবে হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার প্রয়োজন হবে না বলে মন্তব্য করে ত্রাণমন্ত্রী মায়া বলেন, হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকার সবই করবে। যতদিন ঘরে ধান না উঠবে, ততদিন খাবার সরবরাহ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি মানুষকেও না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। এছাড়া এটি রাষ্ট্রপতির এলাকা। তার নির্দেশে সরকার সবকিছু করবে। মন্ত্রী বলেন, প্রাথমিকভাবে কিশোরগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জন্য ১৬ লাখ টাকা ও আড়াইশ’ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দ আরো বাড়বে বলেও মন্ত্রী জানান। সমাবেশে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল হাওরাঞ্চলের মানুষকে ‘সাহসী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, হাওরাঞ্চলের মানুষের সহজে মনোবল ভেঙ্গে যায় না। তারা দুর্যোগ মোকাবেলা আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
এবারও তারা দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হবে। সমাবেশ শেষে মন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত ১৭০টি পরিবারকে বিনামূল্যে ২০ কেজি করে চাল প্রদান করেন। এসময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ, জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশললী মো. শফিকুল ইসলাম, মিঠামইনের উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুস সাহিদ ভূঁইয়া, ইটনার উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসানসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীগণ উপস্থিত ছিলেন।