দোয়ারার মানিকপুরে লিচুর বাম্পার ফলন
দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার রসাল মিষ্টি ফল লিচু এখন ডালে ডালে ঝুলছে। সুস্বাদু লিচু উৎপাদনের উপর নির্ভর করে মানিকপুরসহ দোয়ারাবাজার উপজেলার ৭-৮টি গ্রামের লিচু চাষীদের জীবন জীবিকার। ছাতকের নোয়রাই ইউনিয়নের লিচুর গ্রাম হিসেবে পরিচিত মানিক পুরে লিচুর চাষাবাদ শুরু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। জমিদাররা মানিক পুরে লিচু চাষাবাদ করে রেখে যাওয়া সেই পুরনো বড় বড় গাছ গুলো আজো দাঁড়িয়ে আছে নিজের গতিতে। প্রতি বছর শত বছরের ওই গাছ গুলো থেকে উৎপাদন হয় লাখ লাখ টাকার দেশীয় জাতের সুস্বাদু লিচু। জমিদারদের লিচু চাষের আগ্রহ থেকেই স্বাধীনতাত্তোর ওই গ্রামে কৃষকরা ব্যাপক হারে লিচু চাষাবাদ শুরু করেন। শুধু মানিক পুরেই কয়েকশ’ কৃষক পরিবার লিচু চাষ করছেন। এখানে এমন কোনো বসতবাড়ি ভিটা পাওয়া যাবেনা যাদের বাড়িতে অন্তত একটি লিচু গাছ নেই।
দুই উপজেলার মিলনস্থল মানিক পুরে প্রতি বছরই কোটি টাকার লিচু উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা। রাঙ্গামাটির মেঠোপথ ধরেই মানিকপুরের দেখা যায় উঁচু নিচু টিলায় সারি সারি লিচুর বাগান, প্রতিটি পরিবারের বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গাছের ডালে ডালে পাকা লিচুর ঝলকানি মনোরম পরিবেশের দৃশ্য মুগদ্ধ করে সবাইকে। যুগ যুগ ধরে এখানকার বাহারি লিচু উপজেলা ও জেলা শহর সহ রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করে থাকেন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে মূলত লিচুর গ্রাম গুলোর কৃষাণ-কৃষাণীরা মধুর উৎসব মনে করেন। পুরুষদের সাথে মহিলারাও সমান তালে ওই এলাকায় লিচু উৎপাদন ও বাজার জাতে কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন।
মানিকপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের লিচু চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- শত বছর পূর্বে গৌরিপুর জমিদারের ছাতক-দোয়ারাবাজার এস্টেটের নায়েব হরিপদ রায় ও শান্তি পদ রায়ের কাচারি বাড়ি মানিকপুর গ্রামে লিচুর বাগান করেছিলেন। কালান্তরে শতবর্ষী ওইসব লিচু গাছ থেকেই ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে দুই উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামে লিচুর আবাদ হচ্ছে এখন। লিচুর গ্রাম হিসেবে সেই আদিকাল থেকেই পরিচিত লাভ করেছে মানিক পুর। আর এ গ্রামের কৃষকদের উৎসাহ উদ্দীপনায় বিগত এক যুগ ধরে দোয়ারাবাজার উপজেলার, লামাসানিয়া, লাস্তবেরগাঁও, পরশ্বেরীপুর, টেংরাটিলা, টিলাগাঁও, নৈনগাঁও, বিরসিং, পাইকপাড়া, ছাতক উপজেলার চানপুর, গোদাবাড়ি, বড়গোল্লা কচুদাইড়, বেশ কয়েকটি গ্রামে লিচুর বাগান সম্প্রসারিত হয়েছে। লিচুর গ্রামগুলোতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অতিথিদের আপ্যায়নের প্রথম ধাপ সেরে নেন লিচু দেয়ার মাধ্যমে। এখানকার লিচু চাষীদের এতো আনন্দের মাঝেও রয়েছে না বলা দুঃখের কথা।
স্বরেজমিন লিচুর গ্রাম মানিকপুর গ্রামের বাগান মালিক ছাইদুর রহমান, মাওলানা আবু হানিফা, জামাল উদ্দিন, কুদ্দুছ মিয়া, আরব আলীসহ একাধিক লিচু চাষীরা জানান- প্রতিবছরই যথাসময়ে লিচু গাছের পরিচর্যা দিয়ে ভাল ফলনের উপযোগী করে তুলি। কঠোর পরিশ্রম ও পরিচর্যার মাধ্যমে ফলনও ভাল হয়। কিন্তু ফল পাকা শুরু হলেই পাহাড়ি বাঁদুর ও চামচিকা জাতীয় পাখির উপদ্রবে লিচু আধা পাকা থাকতেই বিক্রি করতে হয়।
লিচুর গ্রামগুলোতে বিশেষ করে লামাসানিয়া ও মানিকপুর গ্রামে বিদ্যুৎ না-থাকায় এসব পাখির উপদ্রব থেকে পাকা লিচু বাঁচাতে স্থানীয় প্রযুক্তিসহ কমপক্ষে এক মাসের বেশি সময় রাত জেগে পাহাড়া দিতে হয় লিচু বাগান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে এবং বৃষ্টি এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড়ি বাঁদুর ও চামচিকারা হানা দেয় লিচু বাগানে। এক মিনিট সময় পেলে এক সাথে থাকা হাজার হাজার পাহাড়ি বাঁদুর ও চামচিকারা নিমিশেই কোটি টাকার বাগান খেয়ে বিনষ্ট করে ফেলতে পারে। এদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে কৃষকরা অত্যন্ত সুকৌশল অলম্বন করে গাছের মগ ডালে টিন বাজিয়ে, জাল দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে শোরচিৎকারের মাধ্যমে পাখির উপদ্রব ঠেকানোর চেষ্টা করে থাকেন। তার পরও বাগানের ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ ফল পাখিদের উপদ্রবে বিনষ্ট হয় প্রতি বছর। লামাসানিয়া গ্রামে কৃষক মজলু মিয়া জানান- এখনো লিচু সব বাগানে ভালো করে পাকেনি। সবে মাত্র লালটে রঙ হয়েছে। এর মধ্যেই অনেক বাগান বিক্রি হয়েগেছে। অনেক কৃষকরা কঠোর পরিশ্রম আর পাখির উপদ্রবের কারণেই লিচু পাকার আগেই বিক্রি করে দেন বাগান।
লিচু চাষী আব্দুল মমিন, জামাল উদ্দিন ও আরব আলী বলেন- প্রতিবছরই তাদের বাগানের শতকারা ৪০ ভাগ লিচু বিনষ্ট হয় পাখির উপদ্রবে। ওই গ্রামে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা না-থাকায় তারা পাখির উপদ্রব থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। আর এ কারণেই লিচু পাকার আগেই কম মূল্যে বিক্রি করে দেন অনেক চাষীরা। বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকলে আলোর কারণে রাতের অন্ধকারে আর পাহাড়ি বাঁদুর ও চামচিকা জাতীয় পাখি বাগানে হানা দিতে পারবেনা। তারা জানান- বিদ্যুৎ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থকলে শত ভাগ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হতো এবং উৎপাদিত লিচু ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারতেন এখানকার কৃষকরা। কৃষকরা মনে করছেন- তারা স্থানীয় কৃষি অফিসের সার্বিক পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানসহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে উৎপাদিত লিচু স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।