দ্বিতীয় দফা রিমান্ডেও তুহিনকে হত্যার কথা স্বীকার করেনি বাবা
দিরাই:: দিরাইয়ে সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী শিশু তুহিন হত্যায় পিতার সম্পৃক্ততা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠছে পিতা কি আসলেই সন্তানের হত্যাকারী? না এর পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোন কাহিনী। প্রথম দফা তিন দিনের রিমান্ডে তুহিনের পিতা আব্দুল বাছির, দুই চাচা আব্দুল মছব্বির ও জমশেদ আলীর মুখ থেকে হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি পায়নি। গত সোমবার দ্বিতীয় দফা আবারো পিতা আব্দুল বাছিরকে পাঁচ দিন ও দুই চাচাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় দিরাই থানা পুলিশ। দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে তুহিনের দুই চাচা আব্দুল মছব্বির ও জমশেদ আলীকে বৃহস্পতিবার ও পিতা আব্দুল বাছিরকে শনিবার আদালতে হাজির করে পুলিশ। তবে রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় তুহিনের পিতা আব্দুল বাছির দ্ইু চাচার জবানবন্দি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তদন্তের স্বার্থে এখন কিছুই বলা যাবেনা বলে জানায় পুলিশ। তুহিনের পিতা ও দুই চাচাকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়েছে। আদালত সুত্রে জানা যায়, তুহিনের পিতা আব্দুল বাছির ও দুই চাচা আব্দুল মছব্বির ও জমশেদ আলীর কাছ থেকেও এখন পর্যন্ত কোন স্বীকারোক্তি মূলক জবান বন্দি নিতে পারেনি আদালত। এদিকে এখনো তুহিনের মা মনিরা বেগম এই ঘটনায় তার স্বামী জড়িত থাকতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন না। চাচাতো ভাই শাহরিয়ারের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তির বিষয়টিও মেনে নিতে পারছেন না তার মা খাইরুন নেছা। তার সন্তানের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। শিশু তুহিন হত্যায় তার মা, চাচীসহ সচেতন এলাকাবাসী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সুষ্ঠু ও অধিকতর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউড়া গ্রামে গিয়ে তুহিনের পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, তুহিনের পিতা আব্দুল বাছিররা কেজাউড়া গ্রামের যে পাড়ায় বসবাস করেন তাদের পরিবারই কেবল এই পাড়ায় একা বসবাস করেন। আত্মীয়-স্বজনরা এই পাড়া থেকে অনেক দূরে থাকেন। তাদের বাড়ির চারপাশেই প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বারের আত্মীয়-স্বজনদের বাস। আনোয়ার মেম্বারের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে তাদের নানা বিষয়ে পুরনো বিরোধ রয়েছে। জানা গেছে, আব্দুল বাছিরের ২০ দিন বয়সী মেয়ের জন্মের কয়েক দিন আগে আব্দুল বাছিরের সঙ্গে তার ভাই নাসিরের তুমুল ঝগড়া হয়। এ নিয়ে আব্দুল বাছিরের সঙ্গে নাসিরের ও তার পরিবারের কথাবার্তা বন্ধ ছিল। প্রায় দেড় দশক আগে পার্শ্ববর্তী মধুপুর গ্রামের মুজিব(পিতা কর্তৃক ত্যাজ্য) হত্যা মামলায় ছোট কালে মা হারানো ১৬ বয়সী বাছিরকে আসামি করা হয়। এতে তার বাবা এলাকার সুনামধন্য ব্যক্তি মহিম উদ্দিন তালুকদার খুবই মর্মাহত হন।দিরাই থানার একাধিক মামলার আসামী মুজিব নারী সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে কেজাউড়া গ্রামের এলাইছ মিয়া তার বোন জামাই কনুরোল ও তার স্বজনদের হাতে খুন হন বলে জানান এলাকাবাসী। এই মামলায় আব্দুল বাছিরকে আসামি করায় তার বাবা মৃত্যুর আগে মামলার খরচের জন্য বাছিরকে আলাদা করে কিছু জমি দান করে যান। এই জমি নিয়ে সম্প্রতি তাদের মাঝে পারিবারিক বিরোধ ছিল। তবে পরিবারের মহিলারা জানান বিষয়টি নিয়ে ভাই ভাইয়ে কোন সময়ই বড় কোন সংঘাত হয়নি। এলাকার কয়েকজনের সাথে আলাপকালে আরও জানান প্রায় চার বছর আগে গ্রামের আধিপত্য কে কেন্দ্র করে আব্দুল বাছিরের গোষ্টির লোকজনের সাথে প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বারের লোকদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের মামলা হয় থানায়।
এরই মাঝে আব্দুল বাছিরের স্বজন গিয়াস উদ্দিন তার স্ত্রী নিলুফা বেগমকে নিয়ে নিজ বাড়ি থেকে একই গ্রামে শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় সন্ধ্যারাতে প্রতিপক্ষের হামলার স্বীকার হয়। পরদিন গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী নিলুফা বেগম সিলেটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এঘটনায় নিলুফা বেগমের পিতা বাদি হয়ে প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বারসহ ১৬ জনকে আসামী করে থানায় হত্যা মামলা করেন,মামলায় আদালকে স্বাক্ষী চলছে। এ মামলা আনোয়ার মেম্বারসহ আসামীরা ক্রমান্বয়ে দীর্ঘদির কারাভোগ করে জেল হাজত থেকে জামিনে বের হয়ে বসবাস করছেন তুহিনের বাড়ির আশে পাশে। মামলা অভিযুক্ত কেউ কেউ ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। তুহিন হত্যাকান্ডের মাত্র তিন দিন পূর্বে পরিবারের প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বার একটি চেক ডিজঅনার মামলায় টানা এক বছর সাজা ভোগ করে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাই নিলুফার হত্যা সাথে তুহিন হত্যাকান্ডের কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কি না বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবী জানান এলাকাবাসী। এদিকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদানকারী শিশু তুহিনের চাচাতো ভাই শাহরিয়ারের মা খাইরুন নেছাও দাবি করেন তার ছেলে এই হত্যাকান্ডে জড়িত নয়। তার নবম শ্রেনীতে পড়ুয়া সন্তানের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন খাইরুননেছা। গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিলুফার বেগম হত্যা সম্প্রতি আপষে নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তুহিন হত্যার দিন মুজিব হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শোনানির দিন ছিল। ওইদিনই নৃশংসভাবে তুহিনকে খুন করা হয়। তাই মুজিব হত্যার বদলা বা নিলুফা হত্যা মামলার সঙ্গে তুহিন হত্যার রহস্য লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন এলাকার সচেতন লোকজন।
তুহিনের মা মনিরা বেগম বলেন, ৮-১০ বছর হয় আমার বিয়ে হয়েছে। তুহিনের বাবা কখনো আমাকে গালি দেননি। খুবই সহজ সরল একজন লোক পিতার রেখে যাওয়া জমিতে কৃষি কাজ করেই সংসার চালান। সন্তানদের মারধর করেননি কখনো। বাচ্চাদের খুব আদর করতেন। আমি বিশ্বাস করিনা তুহিনকে তার বাবায় হত্যা করেছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে তুহিনের বাবা জড়িত। আইনের লোকদেরকে নিরপেক্ষ ও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে খুনি বের করার দাবি জানান তুহিনের মা মনিরা বেগম। তুহিনের মামা নূরুজ্জামান বলেন, আমার বোন জামাই কখনো আমার বোন ও তার সন্তানদের গালমন্দ করেনি। এই মানুষটি তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে-বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। তুহিন যে রাতে বাবার কাছ থেকে বিছানায় নেই এর প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী চাচাতো বোন তানিয়া জানায় ,আমার চাচা আব্দুল বাছির তখন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন, ঘরের দরজা খোলা দেখে চাচাকে জাগিয়ে তুলি,আমার ভাই উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্র শাহরিয়ার। সে কোন ভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়।ঐদিন আমার মা ও আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয়েছিল।
রাতে থানায় পুলিশের লোকজন আমার চাচা নাসির ও ভাইকে খুব মারপিট করে শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তি নিয়েছে। জানা যায় শিশু তুহিন হত্যায় ঘটনার পরদিন পরিবারের লোকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসার ৩ ঘন্টার মাথায় মৌখিকভাবে পরিবারের ৩ জন এবং এর পরদিন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তুহিন হত্যায় চাচার সঙ্গে বাবাও জড়িত রয়েছেন বলে জানান সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের পর আদালতে তোলা হলেও পিতার স্বীকারোক্তি না পাওয়া, ঘটনার ১৩ দিন পরও মামলার এজাহার প্রকাশ না করায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই ১৮ অক্টোবর শুক্রবার সিলেটের ডিআইজি কামরুল আহসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে। আমেরিকা থেকে দেশে এসে পরের বুধবার ঘটনাস্থলে আসেন সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।
উল্লেখ্য, গত ১৫ অক্টোবর ভোর রাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে জবাই করে খুন করা হয় শিশু তুহিন হাসানকে। হত্যার পর তার দুই কান ও লিঙ্গ কেটে ফেলা হয়। গ্রামের সালাতুল ও সোলেমানের নাম লেখা হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত দুটি ছুরি তুহিনের পেটে ঢুকিয়ে মসজিদের পাশে কদম গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় ওইদিন তুহিনের বাবা, তিন চাচা, চাচাতো ভাই, চাচী ও চাচাতো বোনসহ ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। রাতে প্রতিপক্ষকে মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ফাঁসাতে তুহিনের পরিবার এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে জানায় দায়িত্ব প্রাপ্ত জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।।ওইদিন রাত ১১ টায় তুহিনের বাড়িতে গিয়ে মা অসুস্থ্য মনিরা বেগমের কাছ থেকে একটি কাগজে দস্তখত নিয়ে অজ্ঞাতনামা ১০-১২জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। ১৭ অক্টোবর তুহিনের চাচী ও চাচাতো বোনকে ছেড়ে দিয়ে বাবা আব্দুল বাছির, চাচা মওলানা আব্দুল মোছাব্বির, নাসির, জমসেদ ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ারকে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। আদালতে চাচা নাসির ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বাবা বাছির, চাচা মোছাব্বির ও জমসেদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দেওয়ায় ওইদিন তাদেরকে প্রথম দফা ৩দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গত শুক্রবার বাবাকে আদালতে তোলা হলেও তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দেননি। ওইদিন প্রথম দফা রিমান্ড শেষে বাবা ও দুই চাচাকে কারাগারে প্রেরণ করে পুলিশ। গত সোমবার আবার বাবা ও দুই চাচাকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এদিকে প্রথম দফা রিমান্ডে স্বীকারোক্তি না দেয়া, আদালতে তোলার পরও পিতার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ এবং শিশু তুহিনের মায়ের ছেলে হত্যায় পিতার সম্পৃক্ততায় বিশ্বাসহীনতার কারণে তুহিন হত্যায় তার বাবার সম্পৃক্ততা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সচেতন লোকজন। সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবি অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার দাস রায় বলেন, পুলিশের তড়িঘড়ি তদন্তে বড়ই ঘাটতি আছে। যারাই জড়িত আছে শুধুমাত্র পিতা বা চাচা নয়,প্রকৃত যারা খুনি বা তৃতীয় কোন পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কিনা প্রতিপক্ষের লোকদের এ ব্যপারে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শাহানা রব্বানী বলেন,অন্তত পক্ষে তুহিনের বাবার পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। পুলিশের পক্ষে এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কে বা কারা জড়িত এতো আগে বক্তব্য না দিয়ে অন্তত পক্ষে হাতের চাপের রিপোর্ট নিয়েও বলা যেতো।সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, তুহিন হত্যায় আর কেউ জড়িত আছে কি-না বলা যাচ্ছে না বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। এই মামলায় তদন্তে যাদের নাম আসে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমান সংগ্রহ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চার্জশীট দাখিল করবো।