দ্বিতীয় সংক্রমণ ঠেকাতে নতুন কৌশলের সন্ধানে
বার্তা ডেস্ক :: করোনার টিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে দ্বিতীয় সংক্রমণের আশঙ্কা। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়, টিকা উদ্ভাবনে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে দ্বিতীয় সংক্রমণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এখনো প্রথম সংক্রমণে ঝুলে থাকার পাশাপাশি টিকার অগ্রগতিও ঝুলে আছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও অনেকটা তাই। টিকার সম্ভাবনা যত জোরালো হচ্ছে, সঙ্গে জোরালো হচ্ছে দ্বিতীয় সংক্রমণ ইস্যুও। প্রথম সংক্রমণের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এই দফায় অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নতুন কোনো কৌশলের সন্ধান মিলছে না। আগের কৌশল থেকে বেশ কিছু বিষয় বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আরো কঠোরভাবে কার্যকর করার কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। সরকারের সামনে মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে সতর্কতা। বিশেষজ্ঞরাও সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার প্রথম সংক্রমণ কাটিয়ে না উঠতেই দ্বিতীয় সংক্রমণে জোর দেওয়া নিয়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, তাপমাত্রার সঙ্গে করোনার যৌক্তিক কোনো প্রভাব এখনো প্রমাণিত হয়নি। ফলে শীতকালে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ শুরু হবে এমন তথ্য কিছুটা ভুল বার্তা দিতে পারে। বরং প্রথম সংক্রমণে এখনো কেন মৃত্যু কমছে না, শনাক্তের হার আরো নিচে নামছে না, ভালো করে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দ্বিতীয় ধাপের করোনা সংক্রমণ রোধে এবার লকডাউনে না গিয়ে আগের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে কঠোর হওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সায় পাওয়া গেছে। এর জন্য শপিং মল, যানবাহন, হাট-বাজার, অফিস-আদালতসহ জনবহুল এলাকায় মাস্ক ব্যবহারে মানুষকে বাধ্য করতে দ্রুত প্রশাসনিক অভিযান শুরু হবে। যারা মাস্ক পরবে না, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেও বাধ্য করা হবে। এ জন্য মাঠে নামবে মোবাইল কোর্ট ও সমন্বিত মনিটরিং টিম। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে মসজিদের মুসল্লিদের মাস্ক পরতে বাধ্য করাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে জোরালোভাবে কথা বলেছে কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। গত রবিবার কমিটির ২০তম সভায় দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রুত নির্ণয় করে তা প্রতিরোধে এখনই করণীয় বিষয়ে রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। এতে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্যরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, চলমান সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও বর্তমানে পরীক্ষার সক্ষমতা বৃদ্ধি, হাসপাতালে সেবার পরিধি ও মান উন্নয়ন করা হয়েছে। যেসব বিষয়ে এখনো উন্নয়ন প্রয়োজন, সেসব ঘাটতিও চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য এখনো আইসোলেশন কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে। আইসোলেশন সেন্টারগুলো পুরোপুরি বন্ধ না করে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যাতে আবার ব্যবহার করা যায় সেই প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। এদিকে বিশেষজ্ঞরা কভিড-১৯ চিকিত্সায় এক্স-রে ও রক্তের কিছু পরীক্ষার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, শহরের হাসপাতালগুলোতে এ ব্যবস্থা থাকলেও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে তা আরো বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রুত নির্ণয়ে বেশি করে টেস্ট করা প্রয়োজন। সংক্রমণ প্রতিরোধে সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইসোলেশনে নিতে হবে।
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদক্ষেপ বিষয়ে বলা হয়, টিকা উৎপাদনে সারা বিশ্ব সক্রিয়। তার পরও কার্যকর টিকার প্রাপ্যতা সময়সাপেক্ষ। জীবিকার স্বার্থে লকডাউন সম্ভব নয়, তাই সঠিকভাবে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই কভিড-১৯ প্রতিরোধে একমাত্র উপায়। এ ব্যাপারে জনসাধারণকে আরো সচেতন করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিভিন্ন দেশ থেকে যাত্রীরা দেশে আসছেন। ফলে ভ্রমণসংক্রান্ত নিয়ম জারি করা প্রয়োজন। সংক্রমণ প্রতিরোধে পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। বিদেশ থেকে আগতদের স্ক্রিনিং, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর জন্য করোনাট্রেসার অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনরত স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়ে আলোচনা হয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে তাঁদের পরিবার-পরিজনও কভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে। চিকিৎসকদের মতামত অনুসারে হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের পর স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনের নিরাপদ আবাসন প্রয়োজন।
এদিকে স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘টিকার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগতি খুবই ভালো। যেখানেই আগে টিকা পাব, সেটাই আমরা আনার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। টাকাও বরাদ্দ আছে। এ ছাড়া টিকা উদ্ভাবনে যুক্ত পাঁচটি কম্পানির সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ চলছে। আর চীনের টিকার ট্রায়াল কবে শুরু হবে, তা দু-এক দিনের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ভারত, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কোনো কোনো কম্পানি আমাদের এখানে ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেছে, যা বিবেচনায় রয়েছে।’তিনি আরো বলেন, করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধে আজ মঙ্গলবার আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক হবে। সেখানে করণীয় ঠিক করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘দ্বিতীয় সংক্রমণ যে হবেই, সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে আগের মতো পরিস্থিতি যাতে না হয় সে জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি রোডম্যাপও করা হয়েছে। নতুন কৌশল পাওয়া সহজ নয়। তাই আগের কৌশলগুলো আরো কার্যকর করার ওপরই আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। মানুষকে আরো সচেতন করতে হবে।’