‘নারীবাদ’ নিয়ে গত কদিন থেকে নারীবাদীদের মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেশ শোরগোল দেখা যাচ্ছে!

‘নারীবাদের’ লক্ষ্য কী হবে? লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ কী? কোন মতবাদ  শুদ্ধ, কোনটি অশুদ্ধ এ নিয়ে বেশ জল ঘোলা হচ্ছে?

আমার স্যারের কথাটি মনে পড়ছে ‘যা যৌক্তিক, যা বিশ্বাস করবেন, তাই লিখবেন।

নারীবাদীদের লক্ষ্য কী? নারীর উন্নয়নই তো। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, মর্যাদা বোধের লড়াই-ই তো? তবে এত বিভেদ কেন? এত জল ঘোলা কেন?! জল যদি ঘোলাই করেন এর সুযোগ কিন্তু নিবে ‘পুরুষতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা।’

হ্যাঁ একটা অস্থির সময় পার করছি আমরা। নারী জাগরণের এই যে হাওয়া বইছে, ফের নতুন করেই বইছে  অনেকেই কিছুটা বিভ্রান্ত হয়তো! ভাবছেন কোন পথটি সঠিক? আরও আছে নিজেকেই সঠিক ভাবা আর অন্যকে বেঠিক ভাবার প্রবণতাও।

এই যে নারীর ভেতর জাগরণের ঢেউ উঠেছে এই ব্যাপারটি ধরে রাখতে হবে আমাদের। পরিবর্তনের সময়টা অস্থির হবেই, এটাই স্বাভাবিক তাই বিভ্রান্ত হলে চলবে না।

পুরুষতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতাকে সুযোগ দেওয়া চলবে না নিজেদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে, এই নারী জাগরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে।

আমি নতুন করে নারী জাগরণ শুরু হয়েছে লিখলাম, এটা নয় যে নারীর মুক্তির আন্দোলন আগে ছিল না, তা নয়, ছিল সবকালেই। আমি নতুন বলতে বুঝাতে চাচ্ছি, ফের আমরা দেখতে পাচ্ছি সর্বত্র নারীরা আবার একটা জাগরণের উৎসবে মেতেছেন। যেন  প্রাপ্যটা বুঝে নিতে চান তারা, বঞ্চনার অবসান চান। উদ্দীপনা, উৎসাহ নিয়ে আজ নারীরা আরও সচেতন তাদের মর্যাদাবোধের লড়াইয়ে।

এ জাগরণের সময়কাল, বিশ্বজুড়েই তো পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। একজন ফেসবুক ইউজার লিখেছিলেন, প্রান্তিক নারীরা তো মর্যাদা বোঝেন না, তারা বোঝেন পেট ভরে খাবার। আমি বলি না বোঝেন, এই যে তাদের ভালো থাকার লড়াই, পেট ভরে খাবার লড়াই এটাই তাদের অধিকার ও মর্যাদাবোধের লড়াই। আজ নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থান এর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, শহুরে শিক্ষিত নারীরা তো বটেই গ্রামীণ বা সাধারণ শহুরে প্রান্তিক নারীরা আজ বেছে নিচ্ছে নিজের অবস্থা পরিবর্তনের উপায়, কর্ম। সামাজিক অহেতুক বাধা, পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করতে শিখেছে আজকের নারী।
বাল্য বিবাহ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ভেঙে দিচ্ছে কন্যা শিশুরা। এসব দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি দেখা যাচ্ছে।

আমি শহুরে প্রান্তিক নারীদের দেখেছি বাসাবাড়িতে কাজ করে তারা সমিতিতে মাসে মাসে টাকা জমাচ্ছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন অথচ কয়েকবছর আগেও এ অবস্থাটা ছিল না। উত্তরবঙ্গে না খেয়ে মারা যাওয়ার কথা শোনা যেত।
আজ নির্মাণ শ্রমিক নারী, রাস্তা সংস্কারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছে। আসলে যা সবচাইতে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে নারীদের মাঝে উপলব্ধি বোধের জাগরণ ঘটাতে হবে।
নারীর মুক্তি আন্দোলনের পথে সকল নারীই আমাদের সহযাত্রী যারা যেখানে যেভাবে পারছেন নিজের বা নারীদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়ছেন।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি, একসময়  আশির দশক পর্যন্তও দেখা গেছে গৃহপরিচালিকা নারীর কাজের যথাযথ প্রাপ্য দেওয়া হতো না। নির্দিষ্ট কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা সকল কাজ করতেন। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। প্রতি কাজের বিনিময়ে তারা আলাদা আলাদা অর্থ নিচ্ছেন। এই ব্যাপারটি কিন্তু তারা এমন নয় ব্যাপক পড়াশোনা করে শিখেছেন বরং তাদের ভেতরকার ভালো থাকার ইচ্ছে বা আরও খানিকটা উন্নত জীবনযাপনের ইচ্ছেই তাদের উপলব্ধিতে এনেছে ‘আমাদের শ্রমের যথাযথ আর্থিক মূল্য দেওয়া হোক।’ হ্যাঁ, বিভিন্ন এনজিও বা সামাজিক সংস্থা এসব নিয়ে কাজ করেছে সীমিত পরিসরে কিন্তু ওইসব নারীদের মাঝেও উপলব্ধিটা ঘটেছে বলেই তারা পেরেছেন তাদের প্রাপ্য আদায় করতে। আমি বলবো এটাও ওই নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

সুতরাং নারীবাদ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক নয়,  উদ্দেশ্য যদি স্থির থাকে, লক্ষ্য যদি অভিন্ন হয় সব পথের মিলন হবে একই গন্তব্যে। তাই যে যেভাবে ভাবছেন এগিয়ে যান, লক্ষ্য স্থির রাখুন। নাসরীন রহমান

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn