নিজেক মানসিক রোগী দাবি করে সব অস্বীকার করলেন রুবি
রুবি তার ভিডিওতে সালমানের মাকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলেছেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই, তাকে খুন করা হইছে। প্লিজ কিছু একটা করেন, কিছু একটা করেন। সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই, সালমান শাহ খুন হইছে। আমার হাসব্যান্ড এইটা করাইছে আমার ভাইরে দিয়ে। আমার হাজব্যান্ড করাইছে, এইটা সামিরার ফ্যামিলি করাইছে আমার হাজব্যান্ডরে দিয়ে, সবাইরে দিয়ে, সব চাইনিজ মানুষ ছিল। সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই, শালমান শাহ খুন হইছে।’
এসব কথা বলার দুদিন পরেই সালমান শাহ মৃত্যু জট যখন নতুন করে মোড় নিচ্ছিল তখনই রুবি সবকিছু অস্বীকার করেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘সালমান শাহ খুন হতে পারে, আত্মহত্যাও করতে পারে। আমি এর কিছুই জানিনা। কেউ আমাকে গালাগালি করলেও আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি যদি খুনি হই তাহলে আমাকে প্রমাণ করুক যে আমি খুনি। আমি আমেরিকান সিটিজেন। এখানে এসে আমাকে এত সহজে ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রমাণ দিতে পারবো যে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পেরেছি আমি সুস্থ নই। আমার বড় ছেলে আমাকে বলেছে একমাস হাসপাতালে থাকতে। আমার স্বামীই একমাত্র এই অবস্থায় আমাকে সাহায্য করতে পারে।’ লাইভে অনেকেই এসময় রুবিকে পল্টিবাজ বলে মন্তব্য করেন। এর জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমি পল্টিবাজ। কী করতে পারবেন আমার। আমার মানসিক সুস্থতা নেই। তাই আমি পল্টি নিয়েছি।’ তিনি সামিরাকে নিয়ে বলেন, ‘সামিরার ব্যাপারে যা কিছু বলেছি সবকিছু মিথ্যে কথা। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছিলো না। তাই এইসব বলেছি। আমার জন্য কারো কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না।’
বাংলা সিনেমার একসময়কার জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলার আসামি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত রাবেয়া সুলতানা রুবি’র ভিডিওবার্তা নিয়ে প্রবাসীদের মাঝেও শুরু হয়েছে তোলপাড়। তার এ ভিডিওবার্তায় রুবি সবার সাহায্য চাইলেও প্রবাসী সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না তিনি। এমনকি তার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন অনেক প্রবাসী সাংবাদিক। নিউইয়র্কের একজন সাংবাদিক রুবির ফেসবুকে তার সাক্ষাত চেয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি। এছাড়া পেনসিলভেনিয়ার ল্যান্সডেল প্রবাসী সাংবাদিক মফিজুল ইসলাম জানান, বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশিদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে। তবে তিনি পেনসিলভেনিয়ার কোন এলাকায় থাকেন তা তিনি সঠিক জানেন না। টিভির খবরে তার ভিডিওবার্তা দেখে তিনি তাকে চিনতে পেরেছেন।
পেনসিলভেনিয়ার বাংলাদেশি কাউন্সিলম্যান শেখ সিদ্দিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত কমিউনিটি নেতা কাজী মতিউর রহমান, ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জাফর জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া এলাকায় বসবাস করছেন কিন্তু রাবেয়া সুলতানা রুবি নামের কাউকে চিনেন না। এমন কি কোথাও দেখেননি, তবে তিনি তার ভিডিওবার্তা ও খবরটি ফেসবুক ও টিভিতে দেখেছেন।
সম্প্রতি রুবি তার ফেসবুকে দেয়া ভিডিও বার্তায় বলেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন এবং তা করিয়েছিলেন তারই স্ত্রী সামিরা হকের পরিবার। রাবেয়া সুলতানা রুবি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় বসবাস করছেন। রুবি সোমবার ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় সালমান শাহ’র মৃত্যু নিয়ে কথা বলেছেন। রুবি বলেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই। সালমান শাহকে খুন করা হইছে, আমার হাজব্যান্ড এটা করাইছে আমার ভাইরে দিয়ে। সামিরার ফ্যামিলি করাইছে আমার হাজব্যান্ডকে দিয়ে। আর সব ছিল চাইনিজ মানুষ।’ রুবি জানান, স্বামীর নাম চ্যাংলিং চ্যাং, যিনি বাংলাদেশে জন চ্যাং নামে পরিচিত ছিলেন। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে সাংহাই রেস্টুরেন্ট নামে তার একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ ছিল। চিত্রনায়ক সালমান শাহ স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে যে এপার্টমেন্টে থাকতেন, সেখানেই একটি ফ্ল্যাটে রুবি থাকতেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। লাশ উদ্ধারের সময় তার উপস্থিত থাকার তথ্যও রয়েছে।
রুবি দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের পর তার ভাই রুমিকেও খুন করা হয়েছে। ‘ইমনরে (সালমান শাহ’র প্রকৃত নাম) সামিরা, আমার হাজব্যান্ড ও সামিরার ফ্যামিলি সবাই মিলে খুন করছে। ইমনরে আমার ভাই রুমিরে দিয়ে খুন করানো হইছে। রুমিরেও খুন করানো হইছে। আমি জানি না, আমার ভাইয়ের কবর কোথায় আছে। রুমির লাশ যদি কবর থেকে তুলে পোস্টমর্টেম করে, তাহলে দেখা যাবে রুমিরে গলা টিপে মেরে ফেলা হইছে।’ লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে থাকা রুবির বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসা সামিরার বাবা শফিকুল হক হীরা এতদিন পর রুবির এই ধরনের বক্তব্য দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের ফ্ল্যাট থেকে সালমান শাহ’র (শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন) লাশ উদ্ধার করা হয়। তখন আত্মহত্যা হিসেবে দেখে পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা নথিভুক্ত করলেও তাতে আপত্তি জানায় সালমান শাহ’র পরিবার। সালমানের বাবা কমরুদ্দীন আহমেদ হত্যার অভিযোগ তোলেন। কমরউদ্দিনের মৃত্যুর পর সালমানের মা নীলা চৌধুরী ওই মামলা চালাচ্ছেন। পুত্রবধূ সামিরা হক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মাদ ভাইসহ যে ১১ জনকে ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে আদালতে আবেদন করেন নীলা, তারই একজন রুবি। ঘটনার পর দীর্ঘ সময়ে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা বলে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হলেও সালমানের পরিবার বারবারই নারাজি আবেদন করে পুনঃতদন্ত চায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেয় আদালত।
সালমান শাহ’কে কী কারণে হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি রুবির ভিডিও বার্তায়। তিনি দাবি করেন, সালমান শাহ হত্যা মামলার তদন্ত পুনরায় চালু হওয়ায় তার উপর নেমে এসেছে খড়গ। কেননা তিনিই সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি ‘হত্যাকাণ্ড’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। আদালতে তিনি তা প্রমাণও করতে পারবেন। রুবি বলেন, ‘আমি এখানে (যুক্তরাষ্ট্র) পালিয়ে আসছি। আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনারা আমার জন্য দোয়া করেন। আমি কী করব জানি না, এতটুকু জানি, সালমান শাহ (ইমন) আত্মহত্যা করে নাই।’ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে থাকা নীলা চৌধুরী সোমবার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘প্রিয় দেশবাসী। আমাকে সাহায্য করুন। দেখুন, রুবি সুলতানার স্বীকারোক্তি। কীভাবে সালমানকে হত্যা করা হয়েছে।’ রুবির বক্তব্যের বিষয়ে সামিরার বাবা শফিকুল হক বলেন, ‘রুবি যে অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়। আর এতদিন পর রুবি কেন কথা বলছেন, তাও বোধগম্য নয়। সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করেছে, সে সময় তিনি কেন তাদের কাছে এই বর্ণনা দেননি।’
সালমান শাহ’র মৃত্যুর দুই বছর পর সামিরা পুনরায় বিয়ে করেন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক বলেন, ‘ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে আমার মেয়ের। সে রকম কিছু হলে কি কোনো ভালো পরিবার আমার মেয়েকে তাদের ঘরে নিত?’ সালমান শাহ’র মৃত্যু তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে জানান তিনি। ভিডিওবার্তায় নিজের প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন রুবি। রুবির এই বক্তব্য প্রসঙ্গে পিবিআই’র বিশেষ সুপার আবুল কালাম আজাদ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘ভিডিওবার্তায় যে মেয়েটি কথা বলছেন, তাকে আমরা খুঁজছি ।তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। কেননা সে ওই বাসায় থাকত। রুবি নামের এই মেয়েটি সালমান শাহ’র বিউটিশিয়ান ছিলেন।’ পিবিআইকে দিয়ে তদন্তের আদেশ হওয়ার পর আশাবাদী হয়েছিলেন সালমানের মা ও জাতীয় পার্টির এক সময়ের নেত্রী নীলা চৌধুরী। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘এ আদেশটি অসীম অন্ধকারে আমাদের কাছে একবিন্দু আলোর মতো।’
এর আগে নীলা চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আসামি পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করছেন। পিবিআই কর্মকর্তা আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে তারা যে ‘ডকেট’ পেয়েছেন সেখানে প্রয়োজনীয় অনেক আলামত পাননি তারা। সালমান শাহ’র মরদেহের কোনো ছবি না পাওয়ার কথাও বলেন তিনি। ‘দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করলেও ডকেটে মাত্র চারজনের সাক্ষীর কাগজপত্র আমরা পেয়েছি। আরও সাক্ষীর সাক্ষ্য থাকার কথা ছিল। একটি অপমৃত্যুর মামলা এতদিন ধরে তদন্ত করার নজির নেই। অনেক আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর অধিকাংশই দেশের বাইরে চলে গেছেন বা তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
দায়িত্ব পেয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কয়েকজন সাক্ষীর সঙ্গেও কথা হয়েছে তাদের। তদন্তে নতুন কিছু মেলার আশা প্রকাশ করলেও এজন্য সময় চেয়েছেন পিবিআই কর্মকর্তা আজাদ। সামিরা, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও রুবি ছাড়াও নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল সামিরার মা লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে। নীলার মতোই সালমান শাহ’র ভক্তদেরও দাবি, তাদের নায়ক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। বিচার দাবিতে বিভিন্ন সময় আদালত প্রাঙ্গণেও বিক্ষোভ করেছেন তারা। আসামিরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান নীলা।