দুর্গেই পরাজয়ের স্বাদ নিতে হলো আওয়ামী লীগকে। হবিগঞ্জের তিন পৌরসভার দুটিতে ডুবেছে বিদ্রোহের টানাহেঁচড়ায়। একটিতে অল্প ব্যবধানে। জেলার মাধবপুর, নবীগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় এই পরাজয়ের ঘটনা ঘটেছে। নিজেদের দুর্গে পরাজয়ের কারণ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে চুল চেরা বিশ্লেষণ। ভেতরে ভেতরে চলছে আত্মসমালোচনাও। আবার আলোচনায় উঠেছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে কোনো কোনো নেতার প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার বিষয়টিও। তিন পৌরসভায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর হবিগঞ্জ জেলাবাসীর চোখ এখন চুনারুঘাট পৌরসভায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি এ পৌরসভায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এখানেও কি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হবে? এমন নানা প্রশ্ন জেলার চায়ের দোকান, আড্ডা থেকে শুরু করে সব জায়গায়।

শনিবার (১৬ জানুয়ারি) দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর নির্বাচনী এলাকার মাধবপুর পৌরসভায় নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্তের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে তিনি মাত্র ভোট ৬০৮ পান। এ পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক। তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৩১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পঙ্কজ কুমার সাহা। তিনি নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪ হাজার ১৮৫ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের অপর বিদ্রোহী প্রার্থী শাহ মো. মুসলিম। তিনি জগ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫ ভোট। এ পৌরসভায় মোট ১৩ হাজার ১০৫ ভোট পড়েছে।

সহকারী রিটার্নিং অফিসার মো. মনিরুজ্জামান জানান, মোট কাস্টিং ভোটের ৮ ভাগের এক অংশের নিচে পেলে যে কোনো প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্তের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধবপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, জনসম্পৃক্ততা না থাকলে যা হয়। এমন প্রার্থী নৌকা পেয়েছিলেন। তার সাথে একদিন যিনি প্রচারণায় গেছে পরের দিন আর যায়নি। পরাজয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়ন যথাযথ হয়নি। জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না।

মাধবপুরে শোচনীয় পরাজয়ের কারণ হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান রবিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে সিলেটটুডেকে বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ থাকলেই আমাদের ঘাঁটি। কিন্তু সবাই যার তালে থাকলে পরাজয় তো হবেই। আমার উপজেলা সভাপতি দাঁড়াইছেন স্বতন্ত্র। নৌকার মেয়র আগে যেটা পাশ করাইছলাম হিরেন্দ্র লাল সাহা তার আপন ভাই স্বতন্ত্র। এ কারণে আমি ছাড়া অধিকাংশ নেতাকর্মী যার যার তালে বিভক্ত। এর লাগি ফাঁকে এরা গেছে।’

শনিবার দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ পৌরসভায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছাবির আহমদ চৌধুরী। ২৬৪ ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরীকে পরাজিত করে তিনি বিজয়ী হন। তবে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগে আওয়ামী লীগ এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বিষয়ে আইনি লড়াই করার কথা জানান নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, মোট ১০টি কেন্দ্রে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বর্তমান মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট ৫ হাজার ৭৪৯। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট ৫ হাজার ৪৮৫। ২৬৪ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে বেসরকারি ফলাফলে বিজয়ী হন ছাবির আহমদ চৌধুরী।

এদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী ফলাফলের পরিবর্তনের অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। শনিবার রাতে ফলাফল ঘোষণার পর নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নৌকার প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট গ্রহণ শেষে ভোটকেন্দ্রের ফলাফল অনুযায়ী আমি ৯৯২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হই। কিন্তু সরকারি হিসেবে আমাকে ৬৬৯ ভোট দেখানো হয়েছে। আমাকে ইচ্ছা করে ফলাফল টেম্পারিং করে পরাজিত করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন দুটি কেন্দ্রের ফলাফলে পাল্টানো হয়েছে। এসব কেন্দ্রে এজেন্টের কোনো স্বাক্ষর না নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এসব ফলাফল পরিবর্তন করেছেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নবীগঞ্জে প্রার্থীকে ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা এখানে ছিলেন আলোচনায়। তার কিছু বক্তব্যে মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে ভোটের মাঠে নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। এছাড়া নেতাদের প্রচারণায় গিয়ে ফটোসেশন, দলীয় কোন্দলও ছিল বড়। এখানে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে নিজ দলের প্রার্থী পক্ষে তেমন জোরালো কোনো প্রচারণা চালাননি স্থানীয় নেতারা।

নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গিয়াস উদ্দিন মুঠোফোনে রবিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে সিলেটটুডেকে বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ কাজ করেছেন। আমাদের প্রার্থী বিজয়ী ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থীর ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। সেন্টারটি আমার নিজেরই। কিন্তু এখানে আমি অক্ষম। দুই তিনবার আমাকে ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে না যাইতে। বিজিবি এবং পুলিশ। সকালে কেন্দ্র থেকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আমাদের একজন এজেন্ট বের করে দেন। ফলাফল ঘোষণার পর এজেন্টরা রেজাল্টশিট চাইলে কর্মকর্তা দেননি। বলেন উপজেলায় যান। সেখান থেকে নিবেন। কিন্তু সেন্টারে ঘোষণা দেন নৌকা পাশ।’

শায়েস্তাগঞ্জে পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগ পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেন্দ্র মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হলেও কেউ কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানেননি। যার কারণে এখানে পরাজয় হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর।

গত বছরের ২৮ অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ফরিদ আহমেদ অলি ৪ হাজার ৪১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুক পেয়েছেন ৩ হাজার ১৪১ ভোট। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ তালুকদার ইকবাল রোববার (১৭ জানুয়ারি) রাতে সিলেটটুডেকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্রোহীর কারণেই মূলত পরাজয়। এখানে বর্তমান মেয়র হয়েছেন বিদ্রোহী তিনি পেয়েছেন ২৫৯৯ ভোট, যুবলীগের বিদ্রোহী একজন ১৫০০ ও আরেকজন বিদ্রোহী পেয়েছেন ১৪০০ ভোট। বিদ্রোহীর কারণেই এ অবস্থা। তিন বিদ্রোহী ও নৌকার প্রার্থীর ভোট যোগ করলে অনেক বেশি।’

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী রবিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে সিলেটটুডেকে বলেন, ‘আসলে নবীগঞ্জে তো পাশই করছিল। এখানে আমরা যেটা চিন্তা করতেছি, দুই-আড়াইশ ভোটের একটা কারসাজি হইছে। এখানে একটি সেন্টারে এই ঘটনা ঘটেছে। এটা এখনো আমরা ট্রেস করতে পারছি না। সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে কি না, চিন্তা করতেছি। মাধবপুরে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এছাড়া বিদ্রোহী ছিল দুজন। আর শায়েস্তাগঞ্জে ৩জন বিদ্রোহী ছিল। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণেই এই পরাজয়। হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এইবারের পরাজয়টা দুঃখজনক।’

পরাজয়ের পেছনে দলের ভেতরের কোনো কোন্দল ছিল কি না, জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আলমগীর বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে কিছুটা থাকেই। তবে এটা কোনো বিষয় নয়। বিদ্রোহীই মূল কারণ। বিদ্রোহীদের নিয়ে অনেকবার বসছি। তারা মানেনি। পরে তাদের অব্যাহতি দিয়া সেন্ট্রালে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn